অফিস থেকে বিকালে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বের হচ্ছিলাম। আমার স্ত্রী রান্নাঘর থেকে এসে বললো
' আজ বন্ধুদের সাথে টাইম না কাটালে হয়না? প্রতিদিনই তো যাও। আজ যেও না। দেখো বাড়িতে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন মানুষ নেই। আমার একা একা থাকতে ভাল লাগে না। কথা বলার একটা মানুষ নেই। যেও না আজ। আজকে আমাকে একটু সময় দাও না।'
আমি বললাম
ও যেতে দিতে চাইছিলো না। তবুও আমি জোর করে গেলাম। ওখানে বন্ধুরা সবাই আমার জন্য ওয়েট করছে যে। ওদের সাথে জয়েন না হলে দিনই ভালো যায়না।
রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে দেখি ও আমার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গেছে টেবিলে মাথা রেখেই। ও আমাকে রেখে কখনো খায়না। হাজার বলেও এই অভ্যাস পাল্টাতে পারিনি। ওকে তুলে একসাথে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। শুতেই ওর আরেকটা বাজে অভ্যাস শুরু। আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো। এত শক্ত করে জড়িয়ে রাখে যে আমি গেমটাই খেলতে পারিনা। বন্ধুদের কাছে হেরে গিয়ে নানা রকম কথা শুনতে হয়। আমি রেগে ধমকের সুরে বললাম
'সরবে তুমি? প্রতিদিন এমনভাবে শোয়ার কারণ কি? পালিয়ে যাচ্ছি আমি? যত্তসব ফাউল কাজকর্ম। সরো বলছি খেলতে দাও।'
কথাটা বলতেই ও রেগে কান্না করতে করতে বললো
'অপূর্ব তোমার ব্যবহার কতটা নিকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছো তুমি?'
' কিসের নিকৃষ্ট ব্যবহার করছি? ভালবাসিনা আমি তোকে? কোনোদিন গায়ে হাত তুলেছি? নাকি পরকীয়া করেছি আমি। নাকি টাকা পয়সার অভাব রেখেছি কোনটা?'
'গায়ে হাত না তুলেও খারাপ ব্যবহার করা যায়। টাকা পয়সা আর বিছানায় সুখ দিলেই হয়না। এর বাইরেও মানুষের চাহিদা থাকে। আমি সারাদিন বাড়িতে বন্দি থাকার মতো থাকি। কথা বলার মানুষ নেই। তুমি প্রতিদিন অফিস থেকে কাজ করে এসে হাঁপিয়ে গেছো অজুহাতে ঘন্টার পর ঘন্টা বন্ধুদের সাথে কাটাও। শুধু তাইনা। তাদের পাল্লায় পড়ে স্মোক ড্রিংক পর্যন্ত করো। নিষেধ করলে বলো আর এমন হবে না। আজকেই শেষ। কিন্তু না প্রতিদিন এই ঘটনা ঘটাও তুমি। তুমি কাজ করে হাঁপিয়ে যাও আমি হাপাই না? তিন বেলা রান্না, ঘর গোছানো। তোমার সমস্ত কিছু হাতের নাগালে রাখি এগুলো কাজ নয়? আমি কি তোমায় সবদিন নিষেধ করেছি যেতে? না তো। যাও তুমি কিন্তু প্রতিদিন কেন? একটু সময় কি আমায় দেয়া যায়না? রাতে এসে একদিন হয় নিজের চাহিদা মেটাও নয়তো গেম খেলে রাত পার করো। বলতে পারবে ঠিক কবে শেষ বার তুমি আমার সাথে গল্প করেছো? হাসি মুখে জিজ্ঞেস করেছো কেমন আছি? শোনো অপূর্ব যেদিন বিপদে পরবে বন্ধুদের মুখোশ খুলে যাবে। আর আমাকেও সেদিন পাবে না তুমি। আমাকে হারিয়ে বুঝবে তুমি কি ছিলাম আমি তোমার জীবনে। ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয়না। ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় সময় আর যত্ন দিয়ে। তুমি শেষ কবে আমার মুখের দিকে তাকিয়েছো মনে আছে?
প্রতিদিন এই প্যানপনানি ভালো লাগে না। এনজয় করতে দেয় না। সারাদিন বলে এই করো না ওই করো না। অসহ্য হয়ে থাপ্পড় দিলাম জোরে একটা দিয়েই কোনদিকে না তাকিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় কিছুক্ষন হাটলাম। মাথায় খালি ওর বলা কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি জানি ওর সব অভিযোগ সত্যি। তবে অভিযোগ মেটানোর চেষ্টা আমি কখনো করিনি। আমার স্ত্রীর আমার থেকে সময় ছাড়া অন্যকোন চাহিদা নেই। অনেক লক্ষি ঘরোয়া মেয়ে ও। ফোনটা বের করে টাইম দেখতে গিয়ে হঠাৎ তারিখের দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠলাম। ওর জন্মদিন ছিল আজ। আর আমি ওকে একটা উইশ তো দূর উল্টো গায়ে হাত তুলে আসলাম। কথাটা মনে হতেই বুকের মধ্যে হুহু করে উঠলো। যতদ্রুত সম্ভব পা চালিয়ে বাড়িতে এসে রুমে ঢুকতেই আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসলো। মেঝেতে পড়ে আছে আমার স্ত্রী। মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে ভিজে উঠেছে ফ্লোর। ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে হসপিটালে গেলে ডক্টর জানায় মাথার পেছনে আঘাত লাগায় ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। আমার জন্য সব হয়েছে। আমি ওকে রেগে না মারলে ও পরে যেত না আর না ও ভারসাম্য হারাতো।
দেখতে দেখতে কেটে গেল ছয় মাস। ও এখনো ভারসাম্যহীন। বাচ্চাদের মতো হাসে আবার কাঁদে। বিড়বিড় করে। মাঝে মাঝে বলে অপূর্ব যেও না তুমি। ও অস্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে বুঝেছি ও আমার জীবনে কি ছিল। আর বেশিরভাগ বন্ধুদের স্বরূপ ও বেরিয়ে এসেছে এখন। আমি সব হারানোর পরে বুঝছি আমার স্ত্রী কি ছিল আমার জীবনে। আর ওর কথাগুলো কতটা সত্যি ছিল। কিন্তু আজ বুঝেও লাভ নেই। আমি শত সহস্রাধিক বার ক্ষমা চাইলেও সে বোঝেনা। কিন্তু আমি বুঝি অপরাধবোধ কি জিনিস। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম না দিলে কি হতে পারে আমি তার জলন্ত উদাহরণ। সময় গেলে সাধন সত্যি হয়না। আমারও তাই।
Tags
অনুগল্প