আরুশা নুরের বেলীফুলের রাত ।

 ওয়ালিমার প্রোগ্রাম শেষে গাড়িতে উঠতে উঠতে ১২.৪৫ বেজে গেল। সবাই মিলে ধানমণ্ডিতে অরুর বাবার বাড়ির উদ্দেশ্য রওয়ানা দিতে দিতে ১২.৫৩ বেজে গেল। ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে গাড়ি ছাড়ার পরেই। অরু খুব ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে দেখলেই বোঝা যায়। বিয়ের দিন তো কেঁদেকেটে একাকার অবস্থা। গাড়িতে অজ্ঞান হয়ে যায় নাকি সেই ভয়ে ছিল সরফরাজ। বাসর ঘরে ঢুকতেই জামা পালটে ঘুমিয়ে পড়েছিল পাজি মেয়ে। সরফরাজকে সালাম পর্যন্ত করল না। বেয়াদ্দব মেয়ে। সরফরাজ মনে মনে বকে দিয়েছিল অরুকে। সামনে কিছু বলতে পারে না অরুকে। ভয় পায়??? ঠিক তা না। কিন্তু মেয়েটা অদ্ভুত। কেমন জানি। অরুর সবচেয়ে যে বড় বোন সে সরফরাজকে বলেছিল "অরু একটু ছেলেমানুষ, মানিয়ে নিও।" সরফরাজ ভাবছিল, ২৭ বছরেও যদি ছেলেমানুষ থাকে তবে বড় হবে কবে? মরলে? অরুর বড় দুলাভাই বোধহয় শুনতে পেরেছিল সরফরাজের মনের কথা। তাই হে হে করে বলে উঠলেন, "ছেলেমানুষ না, মানে ওই ওর খামখেয়ালিপনা একটু বেশি, তবে ভায়া, মেয়ে ভীষণ ভাল। ওর মনটা অনেক ভাল।"

সরফরাজ কিছু বলেনি শুধু মুচকি হেসেছিল।
এই মেয়ে যে সাধারন না তা প্রথম দেখার দিনই সরফরাজ বুঝতে পেরেছিল। বিয়ের আগে আলাদা কথা বলার জন্য ওদের দুজনকে একটা রেস্টুরেন্টে পাঠানো হয়েছিল। অরু কিছু তো খায়নিই, উলটো সব খাবার পার্সেল করে বাইরে নিয়ে রাস্তার ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। সরফরাজের অনেক রাগ হয়েছিল। কিন্তু কিছু বলেনি। পরে অবশ্য অরুই বলেছিল ও রেস্টুরেন্টে যাওয়ার আগে ডাস্টবিনের পাশে একটা কুকুরকে নাকি খাবার খুজতে দেখেছিল, সেই কুকুরের জন্য খাবার পার্সেল করে নিয়ে ডাস্টবিনে রেখে এসেছে। সামনে যায়নি। কুকুর নাকি ওর ভয় লাগে।
যতটা রাগ লেগেছিল, ততটাই হাসি পেয়েছিল পরে। এই মেয়ে এমন অদ্ভুত কেন? সরফরাজ নির্বিবাদী মানুষ। সাধারণ ভাবে বাঁচতে চায়। বিয়ে করে বউ সামলানো ওর ধাঁচে পড়ে না। তারপরও অরুকে ভাল লেগেছিল। দোনোমোনা করেও শেষ পর্যন্ত বিয়েতে রাজি হয়ে যায় সরফরাজ।
গান বাজছে গাড়িতে। কোল্ডপ্লের গান। cause you're a sky full of stars. I wanna die in your arms. আকাশের তারার ছিটাফোঁটাও নাই। মেঘে ভর্তি। সরফরাজের বিরক্ত লাগছে গানটা৷ কিন্তু অরুর দারুন লাগছে তা অরুর হালকা মাথা নাড়ানো দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। ঠোঁটটাও চলছে মিলিয়ে। সরফরাজ জানালা দিয়ে তাকাল। কোল্ডপ্লের এই অসাধারণ সুন্দর গানটা ও আজ সরফরাজের বিরক্ত লাগছে। কারন আজ রাত অরুর বাবার বাসায় থাকতে হবে। ওয়ালিমার দিন নাইওর যেতে হয়। কতো নিয়ম। কেন যে বিয়ে করে মানুষ। নিজের বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে সরফরাজের অসুবিধা হয় সেই ছোট্ট বেলা থেকেই। মামার বাড়িতে ও ভাল লাগতো না সরফরাজের। ওর জন্যই সরফরাজের মা বাপের বাড়ি কম যেতেন। গেলেও থাকতে পারতেন না খুব একটা। খুব জ্বালিয়েছে মাকে সরফরাজ। শায়লা এতো জ্বালাতো না। আদর্শ সন্তানের সব গুন শায়লার আছে। যেমন মেধাবী তেমন শান্ত। সরফরাজ ও মেধাবী এবং লাইফে সাক্সেসফুল। টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার। এখন আছে গ্রামীণফোনে। ভাল স্টুডেন্ট ও ছিল। কিন্তু মাকে জ্বালিয়েছে অনেক। তার শাস্তি বোধহয় এভাবে আল্লাহ ওকে দিচ্ছে। মা বলছিল সকালে, "এরকম আরো কতো রাত শ্বশুরবাড়ি থাকতে হবে। এতো সবে শুরু।"
এসব ভাবতেই ভাবতেই খেয়াল করল সরফরাজ ওদের বিভিন্ন রঙের ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটা মহাখালীতে ঢুকতেই খানিকটা পিছে পড়ে গেছে। অরুর বাবা ভাইদের গাড়ি গুলো অনেকটা এগিয়ে গেছে। এই রাত একটা বাজেও এতো গাড়ি মহাখালীতে? গাড়িটা আটকে গেল ট্রেনের সিগন্যাল পড়তেই। সরফরাজ খেয়াল করে দেখল অরুর বাবা ভাইদের গাড়ি ওদের আশেপাশে নেই। ট্রেন আসার অনেক আগেই তারা এই বিশ্রী রাস্তা পার হয়ে গেছেন। বৃষ্টিটা বাড়ল মনে হয়।
অরু তাকিয়ে আছে বাইরে। একটা মেয়ের দিকে। পথশিশু। হাতে একটা ডাল। বেলীফুলের ডাল। থোকায় থোকায় বেলীফুল ফুটে আছে। কি সুন্দর। অরুর চোখজোড়া চকচক করে উঠল। রাস্তার ওপাশ থেকে আসছে। অরুর গাড়ির পাশ দিয়ে যেতেই অরু গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ডাক দিল মেয়েটাকে। "এই মেয়ে।, এই। এই পিচ্চি। এই বেলীফুলওয়ালী।" বৃষ্টির ডাকে হোক বা অন্য কোনো কারনে হোক মেয়েটা শুনতে পেল না, ফিরেও তাকালো না। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মেয়েটা হেটে যেতে লাগল অরুর গাড়িকে পিছে ফেলেই। অরু উপায়ন্তর না দেখে, গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল ঝুম বৃষ্টিতেই। সাদা গাউন গায়ে। নিচের দিকে ডার্ক গ্রীন পাথর আর সুতোর নিখুঁত কাজ। বিশাল ঘেড় দেওয়া। ভারীও অনেক। মাথায় সাদা ওড়না। ওরনার ভাল মতো দেয়া নেই। একটা ক্লিপের কারনে মাথায় আটকে আছে কোনো রকমে। সাদা রঙের হিল জুতো পায়ে, সেই বিশাল গাউন দুই হাতে সামলেই অরু বৃষ্টিতে দৌড় দিল সেই বেলীফুল হাতে থাকা পথশিশুর কাছে। সরফরাজ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে কি পাগল। একটু পরেই সিগন্যাল ছেড়ে দিবে৷ ড্রাইভারের দিকে তাকাল। কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। যেন এটা হওয়াটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। এটা অরুর পার্সোনাল ড্রাইভার। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছে সরফরাজ। এখন কি করবে ও? সরফরাজ ও কোনো উপায়ন্তর না দেখে গাড়ি থেকে নেমে ছুটল অরুর কাছে।
অরু মেয়েটার কাছে গিয়ে হাত ধরে বলল, "এই পিচ্চি তোকে ডাকি শুনিস না কেন?"
মেয়েটা হতভম্ব হয়ে দেখছে অরুকে। এ তো বউ। বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে নাকি? কি সুন্দর পোশাক গায়ে। নাকে নথ, গায়ে কি সুন্দর সবুজ পাথরের গয়না। মাথায় ওড়না। পরে যাবে যাবে ভাব। এই বউ তার কাছে কি চায়? এসব ভাবতেই ভাবতেই মেয়েটা দেখে কোথা থেকে দৌড়ে এসে বউয়ের পাশে কোট স্যুট পরা একটা সুন্দর লম্বা ছেলে দাড়িয়েছে। এই ছেলে কি বউয়ের ভাই? নাকি জামাই?
পথশিশু মেয়েটার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই সরফরাজ ধমক দিয়ে অরুকে জিজ্ঞেস করল, "এভাবে বৃষ্টির মধ্যে বাইরে আসলে কেন? একটু পরেই তো সিগন্যাল ছেড়ে দিবে? " অরুর মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সরফরাজ তাকিয়ে দেখে আশেপাশের সবাই ওদের দিকে আছে। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে সবাই অরুকে দেখছে। এই এতো সুন্দর মেয়েটা বউ সেজেছে, সেই বউ আবার গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে, লোকে তো দেখবেই। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, এই এতো সুন্দর বৃষ্টিতে ভেজা বউটার কোনো খেয়াল নেই সেসব দিকে। অরু পথশিশু মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ওর হাতে থাকা ডালটা থেকে একটা ফুল নিয়ে নিজের কানের কাছে গুঁজে দিল। তারপর আরো একটা ফুল ছিড়ে সরফরাজের কোটের বুক পকেটে গুজে দিয়ে বুকের উপর চাপড় মেরে হাসি মুখে বলল, "লুকিং হ্যান্ডসাম গ্রুম।"
সরফরাজের মনে হল সে কোনো মুভির সিনে আছে। বৃষ্টি গুলো স্লো মোশনে পড়ছে। স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। অরু তার নায়িকা। সে মাত্রই অরুর প্রেমে পড়েছে। বাংলা সিনেমার মতো তাই অরুকে নিয়ে সেজেগুজে গান গাইতে আর নাচতে চলে এসেছে এই মহাখালীর জ্যামে। এসব ভাবছে আর চোখের সামনেই দেখছে অরু নিজের ওড়না মাথা থেকে খুলে পথশিশু মেয়েটার মাথায় পেঁচিয়ে দিয়েছে। পথশিশু মেয়েটাকে পরীর মতো লাগছে কি না তা সরফরাজ জানে না, তবে সে জানে, অরুকে পরীর মতো লাগছে। সাদা গাউন গায়ে কানের কাছে বেলী ফুল গুঁজে একটা ডানাকাটা পরী ভুল করে এই বৃষ্টির রাতে মহাখালীর রাস্তায় এসে পড়েছে।
অরুই সরফরাজের হাত ধরে গাড়িতে এসে বসল। সিগনাল ছেড়ে দিয়েছে সেই কখন। আজমল ড্রাইভার জানে অরু কেমন। পাঁচ বছর ধরে অরুর গাড়ি চালায় সে। জানে এই মেয়ের মাথার তার ছেড়া। হুটহাট এমন গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় নেমে উদ্ভট সব কাজ করা অরুর অভ্যাস। কিন্তু মনটা এতো ভাল। তাই সে পেছনের গাড়িগুলোর হর্ন শুনেও গাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে নিজে যায়নি। অরু আর সরফরাজ গাড়ির ভেতরে বসতেই আজমল ড্রাইভার গাড়ি টান দিল। সেই টান। জানালাটা খোলা। বাতাস হুহু করে ঢুকছে গাড়ির ভেতরে। অরু জানালার দিকে মুখ করে বাতাস উপভোগ করছে। আর সরফরাজ উপভোগ করছে বাতাসে উড়তে থাকা অরুর চুল, সিটি লাইটের আলোয় অরুর সৌন্দর্য। গান বাজছে মিউজিক প্লেয়ারে, জেমস আর্থারের কারস আউটসাইড।
oh darling, all of the city lights,
Never shine as bright as your eyes.
লাইন দুটো যেন অরুর জন্যই লেখা। সরফরাজের হয়ে জেমস আর্থার গেয়ে দিলেন। ধন্যবাদ জেমস আর্থার।


নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম