লেখিকা ফারহানা কবির মানালের ননদিনী গল্প সম্পুর্ন।ননদিনী সম্পূর্ণ গল্প

ননদিনী 

ফারহানা কবির মানাল




--" আব্বু তুমি আমার জন্য একটা শাড়ি আনলে কেন? ভাবিও তো আছে! শুধু আমার জন্য শাড়ি আনাটা তোমার উচিত হয়নি। 


আমার ননদের মুখে এমন কথা শুনে আমিসহ সকলেই অবাক। শশুর তখন রাগে লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শাশুড়ী মা মুখ বেঁকিয়ে বললেন,


শাশুড়ী মা ঃ- শোনো মেয়ের কথা! এমন মেয়ে আমি পেটে ধরেছি যে ভরা বাড়িতে নিজের বাপকেই অপমান করছে। 


সকলের মুখেই আমার ননদকে নিয়ে নানান কথা চলছে, কেউ কেউ ওকে অভদ্র বেয়াদব ইত্যাদি বলে গালি দিচ্ছে। মেয়েটার চোখে পানি টলমল করছে। আমার ফুফু শাশুড়ী বেশ করুণ কন্ঠে বললেন,

ভাই দেখ তুই কি মেয়ে জন্ম দিয়েছিস! একবার দেখ। বাড়ি ভরা লোকের সামনে দুইদিনের মেয়ের জন্য তোকে কি অপমানিত হলো। আর তোর এই ছেলের বউ মনে হয় ওকে কোনো তাবিজ-কবচ করছে। না হলে কি কেউ ভাবির হয়ে বাপের বিরুদ্ধে কথা বলে?


বিয়ে বাড়িতে এমন অনেক লোক থাকে যাদের কাজ হলো দুই পক্ষকে ব্যালেন্স করে চলা। তেমনি একজন হলো আমার স্বামীর ছোট মামা। তিনি খুব সুন্দর ভঙ্গিতে আমার ননদে বললেন, তোমার ভাবি তো বিয়েতে অনেক শাড়ি পেয়েছে তাই হয়তো তার জন্য আনেনি। তুমি এমন ব্যবহার না করলেও পারতে মামনি। তুমি ঘরে চলে যাও। 


উনার এমন কথায় মনে হলো, কেউ হয়তো আছে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল করে তিনি শশুর আব্বুকে খোঁজা মেরে বললো, কি রে দুলাভাই!  মেয়েটাকে তো মানুষ করতে পারলেন না। সেই বিগড়াই গেছে।  কি আর করবেন বলেন, সবই কপাল৷ হা হা।


আমার ননদ চুপচাপ সেখান থেকে মাথা নিচু করে চলে গেলো। তারপর ঘরে দরজা আটকে রইলো৷ আমার নাম মুনমুন। অনার্স ১বর্ষের স্টুডেন্ট। আম্মু আব্বু পছন্দ করে আলিফের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। আলিফ চাকরি করে তার ওদের বংশও নাকি ভালো। সকল কিছু খোঁজ খবর নেওয়ার পর আম্মু আব্বু আলিফকেই আমার জন্য ভালো মনে করেছেন। এতো সময় যার সাথে কথা হলো সে আমার ননদ আলিশা। আমরা প্রায় সমবয়সী। ও আমার থেকে ছয় মাসের ছোট। আলিফ, আলিশা, শশুর আর শাশুড়ী এবং আমি।  এই পাঁচ জনের ছোট্ট সংসার আমাদের৷ আমার বিয়ে হয়েছে আজ তিনদিন৷ আর এখনই এমন একটা ব্যাপার হবে আমি বুঝতে পারিনি। আলিশার জন্য খুব খারাপ লাগছে, শুনেছি ননদরা নাকি ভাবিদের সহ্য করতে পারে না৷ কিন্তু আলিশার এমন কাজ আমাকে কথাটা মিথ্যা ভাবতে বাধ্য করেছে। 


সকালের ঘটনার জন্য বাড়ির পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে৷ বিকালের দিকে সকল মেহমানরা চলে গেলেন। কিন্তু তাদের আরো বেশ কয়েকদিন থাকার কথা ছিলো। অফিসে জরুরি কাজের জন্য আলিফ আজ বাড়িতে নেই। সকাল থেকে কেউ কারো সাথে কথা বলছে না৷ অন্যরা অনেক কানাঘুঁষা করছিলো বলে দুপুরে খাওয়ার সময় শশুর সোজা বলে দিয়েছিলো, যাদের বাড়িতে বসে সমালোচনা করতে ভালো লাগছে তারা যেন চলে যায়। বিকেলে সকলেই চলে গেছে। সন্ধ্যার দিকে আলিফ আসতেই শাশুড়ী মা আলিফকে বললেন,


শাশুড়ী মা ঃ- তোর বউ বাড়িতে আসার পরেই আমার মেয়েটার মাথা চিবিয়ে খেয়েছে। আজ বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে কি অপমানটাই না করলো তোর আব্বাকে।


আলিফ আমার দিকে একবার তাকিয়ে সোজা উপরের ঘরে চলে গেলো। আমাদের বিয়ে তিনদিন হলেও আলিফের সাথে আমার তেমন কথা হয়নি৷ আর না তো আমাদের ভিতর স্বামী স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক হয়েছে। ভদ্রতার খাতিরে যেমন কথা হয় তেমনই কথা হয়েছে। আর কথা বলার তেমন সময়ও পাইনি। 


আমি আলিফের পিছন পিছন ঘরে চলে আসলাম। শাশুড়ী মা তখন বিলাপ করেছেন, তিনি কেমন ছেলে মেয়ে জন্ম দিলেন এই নিয়ে। আলিফ আমাকে দেখে ভদ্রতা সূচক হাসি হাসলো৷ তারপর নিজের কাজে মন দিলো। 


কোনো কাজ না পেয়ে আমি আলিশার ঘরের দিকে গেলাম। কয়েকবার ডাকার পর দরজা খুললো। চোখ মুখ ফুলে গেছে ওর। হয়তো সারাদিন কান্না করেছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, 


মুনমুন ঃ- কি করে রেখেছো নিজের হালটা? আসো তো হাত মুখ ধুয়ে আগে কিছু খেয়ে নিবে। আর আব্বুর উপর রাগ করো না৷ উনি হয়তো বুঝতে পারেননি। আর আমার তো বিয়েতে পাওয়া অনেক শাড়ি আছে।


আলিশা আমার দিকে তাকিয়ে উপহাসের হাসি হাসলো। তারপর বললো,


আলিশা ঃ- জানো তো ভাবি। কিছু সম্পর্ক থাকে যা চাইলেও সুন্দর হতে পারে না হয়তো। তুমি খাবার বেড়ে রাখো আমি আসছি। 


আলিশা হয়তো আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললো। বলাটাও স্বাভাবিক  আমার জন্য ও কতটা গালাগালি শুনলো। আর সেই আমিই ওর সাথে এমন ব্যবহার করলাম। নিজের বলা কথাগুলোর জন্য খারাপ লাগছে কিন্তু কি করবো মুখ থেকে বের হওয়া কথা তো ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। 


আলিশা ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে আসলো। শাশুড়ী মা মুখ বেঁকিয়ে বললেন, বাহ বেশ ভালোই তাবিজ করেছে তোকে! আমরা এতো ডাকলাম তুই এলি না আর এখন ড্যাংড্যাং করতে করতে চলে এসেছিস!


আলিশার চোখের কোণে স্পষ্ট পানি দেখা গেলো। বাম হাত দিয়ে পানি মুছে। খাবার খেতে লাগলো৷ একহাতে পানির গ্লাস অন্য হাতে ভাত। ও খাবার খাচ্ছে না বরং পানি দিয়ে গিলছে। এমন সময় আলিফ এসে খেতে বসলো। শাশুড়ী মা দৌড়ে এসে ওকে সব দিতে লাগলেন। রাতের খাবার শেষ হওয়ার পর সকলে যার যার ঘরে চলে গেলো৷ আমি আর আলিফ মুখোমুখি বসে আছি। আলিফ নিজের ল্যাপটপে মনযোগ দিয়ে কাজ করছে৷ কি বর আমার একটা! নতুন বিয়ে হয়েছে, কোথায় একটু গল্প করবো, একটু রোমাঞ্চ করবো। তা না, আমার সাথে কথাও বলেছে না৷ আগে থেকে ওর পরিচয় থাকলে ওর কোলের উপরে উঠে বসে থাকতাম এখন। কিন্তু আলিফকে আমি এখনো চিনিই না ভালো করে, লজ্জা বলে একটা ব্যাপার আছে তো। বিছানায় বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম জানি না। বাড়িতে দেরী করে ঘুম থেকে উঠতাম, ফজরের নামাজ পড়ে আবারও ঘুমিয়ে যেতাম৷ তবে ফজরের নামাজ বাদ দিতাম না৷ রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন


--" ফজরের নামাজ মুনাফিকদের জন্য কষ্টকর। 


কেউ না ডাকায় এই বাড়িতেও ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে নিচে গেলাম। কিন্তু আলিফ আর শাশুড়ী মায়ের কথা কানে আসায় সেখানেই বরফের মতো জমে গেলাম। 

শাশুড়ী মা আলিফকে বলেছে, 


শাশুড়ী মা ঃ- তোর নবাবজাদী বউ এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। বাপের বাড়ি থেকে কি কাজের লোক নিয়ে এসেছে যে বসে বসে খাবে?


শাশুড়ী মায়ের এমন কথায় আলিফ খুব বিরক্ত। মুখে একরাশ বিরক্ত নিয়ে বললো,


আলিফ ঃ- দেখো মা, আমি ওই মেয়েকে নিজের পছন্দে বিয়ে করিনি। এমনকি আমি ওকে দেখতেও যাইনি। তুমি আর বাবাই তো জোর করে বিয়েটা দিয়েছো। তাহলে আমার বউ আমার বউ করো কেন? ওই মেয়েকে আমি বউ হিসাবে মানিনি। কখনো মানবোও না।


শাশুড়ী মা আক্ষেপের সুরে বললেন,


শাশুড়ী মা ঃ- ওর বাপের ৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু এক টাকাও দেয়নি। শেষ সময়ে পুলিশের ভয় দেখিয়ে বিয়ে দিয়েছে। আবার দেনমোহর পরিশোধ করে দেওয়া লাগছে বিয়ের দিনই। 

তুই চাইলে এই মেয়েকে ছেড়ে পছন্দের কাউকে থাকলে বিয়ে কর৷ আমরা আর কিছু বলবো না। 


আলিফের মুখে তখনও বিরক্তির ছাপ। আমাকে দেখে দুইজনই চুপ করে রইলো। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। এমন কথা আমি আগে জানতাম না। জানলে কখনো বিয়েতে রাজি হতাম না। মা বাবা আনাকে কোথায় পাঠিয়ে দিলো। চোখের কোণে হাজারও অশ্রুকণা ভিড় করছে। গালে কারো হাতে স্পর্শ পেয়ে মুখ তুলে তাকালাম। আলিশা আমার চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা মুছে দিলো। তারপর নরম গলায় বললো,


আলিশা ঃ- তুমি যদি কারো কথায় কষ্ট পেয়ে থাকো তাহলে আমাকে বলতে পারো। 


আমি ওর কথা শুনে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।  এমন একজন মানুষ লাগে যাকে জড়িয়ে ধরে সবটা বলা যায়। আমার কথাগুলো শুনে আলিশা অবাক হয়ে বললো,


আলিশা ঃ- তুমি সত্যি বলছো তো? আমি তো বিশ্বাস করতে পারছি না। ভাইয়া এমন! 


ওর কথায় আমি কোনো উত্তর দিলাম না। কি বলতাম আর!  কেউ তো নিজের আপন মা ভাই বাদ দিয়ে আমার কথা বিশ্বাস করবে না। আমি হলেও করতাম না৷ চুপচাপ ঘরে চলে গেলাম। আমার অবাধ্য চোখ থেকে পানি পড়েই যাচ্ছে। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছি না। এমন সময় আলিফ ঘরে এলো। আলিফ আমার চোখে পানি দেখে বললো,


আলিফ ঃ- কি হয়েছে তোমার কাঁদছো কেন? 


কি উত্তর দিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অনেক সময় চুপ থাকার পর বললাম,


মুনমুন ঃ- আমার বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। কিছু ভালো লাগছে না।


আলিফ আমার গালে হাত ডুবিয়ে দিলো। তারপর আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা মুছে দিলো। এই প্রথম হয়তো আলিফ আমাকে স্পর্শ করলো। কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে আমার। আলিফ তো আমাকে বউ হিসাবে মানবে না তাহলে এটা কি শুধুমাত্র সহানুভূতি? শাশুড়ী মা আর আলিফের বলা কথাগুলো মনে পড়তেই চোখ থেকে আবার পানি পড়া শুরু হয়ে গেলো। আলিফ চোখপর পানি আবারও মুছে দিলো৷ তারপর শান্ত গলায় বললো,


আলিফ ঃ- এতো কান্না করো কেন? তুমি৷ কি বাচ্চা নাকি? বিকেলে রেডি থাকবো। অফিস থেকে ফিরে তোমাকে নিয়ে যাবো তোমার আব্বু আম্মুর কাছে।


আম্মু আব্বুর কাছে যাবো শুনে কিছুটা ভালো লাগছে তবে ক্ষত এক জায়গায় আর অন্য জায়গাতে মলম লাগলে কি হয়? তবুও আলিফের কথায় মাথা নাড়ালাম। মায়ের সাথে আমাকে দেখা করতেই হবে, কেন এমন করে করে আমার বিয়ে দিলো সেই কথা জানতে হবে। আমি কি ওদের বাড়ির বোঝা হয়ে গেছিলাম নাকি? নিজের এমন চিন্তার মাঝে হঠাৎ খেয়াল করলাম আলিফ কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। 


আলিফের চোখ এখন মুনমুনের মুখমন্ডলের মাঝে সীমাবদ্ধ। কাঁদলে মুনমুনের ঠোঁট গোলাপি রংয়ের হয়ে যায়। নাক চোখ লাল হয়ে ফুলে ওঠে। এক কথায় বেশ আকর্ষণীয় লাগে মুনমুনকে দেখতে। কিছু সময় নিজের করা কাজের জন্য নিজেই লজ্জা পায় আলিফ। তারপর নিজের কাজে চলে যায়। মুনমুন অবশ্য এসব লক্ষ্য করেনি৷ সে তো আকাশ পাতাল চিন্তা করতেই ব্যস্ত হয়ে আছে। সেদিনের পর থেকে শশুর আব্বা আর আমার সাথে বা আলিশার সাথে কথা বলেনি৷ মাঝে মাঝে শাশুড়ীমার সাথে সামান্য কথা বলতে শুনেছি। নিজেকে যেন খাঁচায় বন্দি পাখি মনে হচ্ছে! যার ইচ্ছে থাকলেও উড়ে বেড়ানোর উপার নেই৷ দুপুরে রান্না ঘরে গেলে শাশুড়ী মা কাটা গলা বলে দিয়েছে, আমি যেন দুপুরে কাজ দেখাতে রান্না ঘরে না ঢুকি৷ তিনি একাই সব কাজ করে নিতে পারবে। আমিও আর কথা বাড়ায়নি। সোজা ঘরে এসে শুয়ে আছি। কান্নার কারণে মাথাটা বড্ড যন্ত্রণা করছে। 


গোসল শেষ করে জোহরের নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর আল্লাহর কাছে বিপদে সাহায্য করার জন্য বললাম। মাথাটা মনে হয় ফেটে যাবে। খাটে গিশে শুয়ে পড়লাম। কখন দুই চোখের পাতা এক হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না৷ কারো চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভাংলো। কিছু বোঝা না গেলেও এটা স্পষ্ট শুনতে পেলাম, 


--" আলিফ তুই আবার একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনলি? তোর না ঘরে নতুন বউ।


এমন কথা কানে আসতে দৌড়ে গেলাম। আলিফের পাশে বধু সাজে একটা মেয়েকে দেখতে পেয়ে আমার কেমন লাগছিলো বুঝতে পারছি না। সকালে আলিফ আমার সাথে কেমন ব্যবহার করলো আর এখন বিয়ে করে নিয়ে এসেছে৷ তাই হয়তো আমাকে বাপের বাড়ি রেখে আসবে বলেছিলো। হঠাৎ কেউ আমার কাঁধে হাত রাখলো। তাকিয়ে দেখলাম আলিশা। ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম











আলিশা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। সত্যি বলতে এমন ননদ পৃথিবীতে আছে কি-না আমার সন্দেহ হয়! আলিশা আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,


আলিশা ঃ- তুমি কান্না করো না। আগে চলো নিচে গিয়ে ব্যাপারটা কি হয়েছে।


কান্নার কারণে আমার হেঁচকি উঠে গেছে, তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,


মুনমুন ঃ- গিয়ে দেখার কি আছে বলো? এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে। তোমার ভাই অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে। 


আলিশা বেশ সিরিয়াস হয়ে বললো,


আলিশা ঃ- জানো ভাবি আমার ভাই এতোটাও খারাপ নয়। এই বিয়েতে ওর মত ছিলো না এটা আমি জানি, তবে তারও অনেক কারণ আছে। আর তুমি জানো তো না জেনে কোনো ব্যাপারে অনুমান করা ঠিক নয়। তুমি হয়তো দেখছো মেয়েটাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে, সাধারণ মস্তিষ্ক এমনটাই বলে। তবে আমাদের কুরআনের নির্দেশ মেনে চলা উচিত। আল্লাহ বলেছেন,


--" হে মুমিনগণ! তোমরা বেশি অনুমান করা থেকে দূরে থাক। নিশ্চয়ই কোনো কোনো অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোস্ত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ বেশি তাওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু।’ (সুরা হুজরাত : আয়াত ১২)


হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা অনুমান থেকে বেঁচে চলো। কারণ অনুমান সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার। আর কারো দোষ খুঁজে অনুসন্ধান করো না। গোয়েন্দাগিরি করো না, পরস্পরকে ধোঁকা দিও না, আর পরস্পরকে হিংসা করো না, একে অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করো না এবং পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ করো না। বরং সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও।’ (বুখারি)


আলিশার কথা শুনে নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলাম। তারপর কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে নিচে গেলাম। সেখানে সবাই ইচ্ছে মত সমালোচনা করছে, আমাকে দেখে আলিফ কিছুটা বিব্রত হলো। তখনও ওকে সকলে জবাবদিহিতা করছে। আলিফ বোশ রেগে বলে উঠলো, 


আলিফ ঃ- Do I care for anybody? আমি কি তোমাদের তোয়াক্কা করি? 


আলিফের এই সামান্য কথায় সকলে চুপ হয়ে গেলো। আলিফ তখনও জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আমি সকলের মাঝে আলিশার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি বলতে আমার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও শরীরে পাচ্ছি না। বিয়ের পরে মেয়েদের কত স্বপ্ন থাকে, আমারও হাজার রঙিন স্বপ্ন ছিলো। তবে তার বদলে এসব হচ্ছে। আলিফের প্রতি যে আমার ভালোবাসা আছে এমনটা নয়। কিন্তু একজন ডিভোর্সী মেয়েকে তার পরিবারকে নানান কথা শুনতে হয়। কোনো দোষ না থাকলেও লোকে নানান কথা বলে, তবে সত্যিটা না জেনে কি কাউকে নিয়ে কিছু বলা উচিত?  একটা মেয়ে কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরেই তো ডিভোর্সের মতো সিদ্ধান্ত নেয়। কেউ কেউ আবার পরকীয়া করে,  তাই বলে সকলকে কি এক মনে করা উচিত। আজ আমি চলে গেলে কাল আমার আব্বু, ভাই, আমার পরিবারের লোকজন কেউ শান্তিতে রাস্তায়ই যেতে পারবে না। গেলেই লোকে নানান কথা জানতে চাইবে! কে পারলো না আপনার মেয়ে সংসার করতে! আগে সম্পর্ক ছিলো নাকি, ছেলে ভালো না? আরো কত কি! এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যে কতটা কষ্টে তা যারা উত্তর দিয়েছে তারা জানে। আমার এমন সব চিন্তার মাঝে আলিফ বেশ সিরিয়াস হয়ে বললো,


আলিফ ঃ- মুনমুন তুমি আজ তোমাদের বাড়িতে যাবে তো? তাহলে রেডি হও। 


আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। হয়তো আজই এই বাড়িতে আমার শেষ দিন। আমার নিজের থেকে আব্বু আম্মুর চিন্তা হচ্ছে। উনাদের মেয়ে চারদিনও সংসার করতে পারেনি এটা হয়তো উনাদের মানতে কষ্ট হবে।  আলিশা একটু খোঁচা মেরে বললো, 


আলিশা ঃ- ভাইয়া এই আপুকে রেখে তুই চলে যাবি?


আলিফ মনে হলো আলিশার কথাটা গায়ে মাখলো না। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। আমিও মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলাম,


মুনমুন ঃ- নতুন আপুকে রেখেই চলে যাবেন?


আলিফের মনে হয় আমার কথায় মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। ওর চোখে মুখে স্পর্শ বিরক্তি চাপ ফুটে উঠেছে। তবুও শান্ত গলায় বললো,


আলিফ ঃ-  It will be quite enough of you come. 


আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। কি আজব লোক রে বাবা। আমি গেলেই হলো তার মানে? কি যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।  তবুও ঘরে গিয়ে রেডি হয়ে এলাম। 

নিচে আসতেই দেখলাম পরিবেশ একদম ঠিক আছে। আলিশার সাথে নতুন মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি সকলকে বিদায় জানিয়ে আলিফের সাথে বেরিয়ে এলাম। এখন কিছুটা ভালো লাগছে, কারণ আলিশা আসার সময় সামান্য দুই কথায় বলেছে ভয় নেই। তোমার বর তোমারই আছে। তবুও আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। আলিফদের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি বেশ দূরে।  বাসে করে যাওয়া লাগে। অন্য যানবাহনে যে যাওয়া যায় না এমনটা নয়। তবে বেশিরভাগ লোকই বাসে করে যাতায়াত করেন। আলিফও আমাকে নিয়ে বাসে চড়ে বসলো। বাসের উঠার পর আমি একটা নিঃসংকোচে আবেদন করে বসলাম, আমি জানালার পাশে বসবো। আলিফ হাসি মুখে আমাকে জানালার পাশের সীটটা দিয়ে দিয়েছে। বাসে জানালার পাশে বসার মজাই আলাদা। কি সুন্দর বাতাস! তবে আজ আমি বিশেষ শান্তি পাচ্ছি না। হয়তো কোথাও একটা কাটা ফুটে আছে। শরীর বা মনের কোথাও কিছু হলে কোনো কাজ যে আগের মতো ভালো লাগে না তা আমি আজ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি। 


আচ্ছা আলিফের কাছে জিজ্ঞেস লরলে কেমন হয় যে ওই মেয়েটা কে! কিন্তু সরাসরি জিজ্ঞেস করতেও তো আমার কেমন লাগছে। কয়েকবার আলিফের দিকে তাকিয়েছিলাম প্রশ্নটা করতে, কিন্তু প্রতিবার সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে আর জিজ্ঞেস করতে পারছি না্। বুঝি না উনি কি আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন নাকি আমি তাকালেই তাকাচ্ছে।  সকল নিরবতা ভেঙে আলিফ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, 


আলিফ ঃ- তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে মুনমুন। 


কথাটা কেমন যেন বুকে গিয়ে লাগলো আমার।  চমকে উনার দিকে তাকালাম। খুব সুন্দর একটা হাসি ধরে রেখেছেন উনি উনার ঠোঁটে। হাসলে যে কোনো মানুষকেই সুন্দর লাগে, কিন্তু উনাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। উনার গায়ের রং খুব একটা ফর্সা না,  আবার উনি খুব বেশি লম্বাও না। পাঁচ ফুট ছয় ইন্ঞ্চি।  তবুও আমার কাছে পৃথিবীর সব থেকে সুদর্শন পুরুষ মনে হচ্ছে। উনি হয়তো একমাত্র ব্যক্তি যাকে নিয়ে এইসকল চিন্তা করা আমার জন্য হালাল তা-ই এমন মনে হচ্ছে। যে কোনো মেয়ের জন্য তার স্বামীই সব থেকে সুদর্শন ও আকর্ষণীয়। আমার বেলাও তাই। কথাগুলো ভেবে নিজেই লজ্জা পেলাম। এমন এক সমস্যার ভিতরও যে আমার এইসব প্রেমময় চিন্তা মাথায় আসছে ব্যাপারটা ভাবতেই নিজের কাছে কেমন যেন লাগছে। তবুও উনার কাছে জানতে চাইলাম, 


মুনমুন ঃ- আপনি আমাকে দেখলেন কোথায়?  আমি তো এখন বোরকা হিজাব পরে আছি। এমনকি হিজাব দিয়ে আমার মুখটাও ঢাকা তাহলে?


আলিফ মুচকি হাসলো। এই ছেলে কি শুরু করছে কে জানে এতো হাসির কি আছে, আমার মনে আজ আবার বসন্ত শুরু হয়েছে মনে হয়৷ শুধু প্রেম জেগে উঠছে। আলিফ মুচকি হেসে বললো,


আলিফ ঃ- তুমি কি জানো না মুসলিম রমণীদের পর্দা করা অবস্থায় সব থেকে সুন্দর লাগে? নীল শাড়ি খোলা চুল এসব কিছুর থেকেও বোরকা হিজাব পরলে মেয়েদের সুন্দর লাগে শুধু আমরা নিজেদের দৃষ্টিতে অনুভব করতে পারি না। কারণ কেউ বেপর্দায় সামনে এলে শয়তান তাকে সাজিয়ে দেখায়। আচ্ছা একটা কথা বলো তো একটা খোসসহ কমলা বা কলা সুন্দর নাকি একটা খোসা ছাড়া কমলা বা কলা সুন্দর?


আলিফের এমন কথা শুনে আমার ওকে কিছুটা ভালো মনে হলো। তারপর শেষ পর্যন্ত সাহস করে উনাকে প্রশ্ন করে বসলাম,


মুনমুন ঃ- আচ্ছা আপনি কি বিয়ে করেছেন?


আলিফ আমার কথা শুনে হেসে গড়াগড়ি দিচ্ছে মনে হয়। নিজের কাজের জন্য এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে।  কেন যে প্রশ্ন করতে গেলাম কে জানে, তবে এই প্রশ্নে এতো হাসির কি আছে? অবশেষে আলিফ হাসি থামিয়ে বললো,


আলিফ ঃ- হুম, অবশ্যই আমি বিবাহিত।  কেন তোমার কি মনে হচ্ছে? 


নেও ঠেলা!  আমি তো ওই মেয়ের কথা জানতে চাইলাম। কিন্তু উনি তো মনে হয় আমার কথা মনে করে বলছেন, আমার এক হাত দিয়ে অন্য হাতের নকগুলো নিয়ে টানাটানি করছি আর এসব ভাবছি। আলিফ হয়তো ভাবছে যে আমি বিব্রত বোধ করছি, তাই আমার ধারণা সঠিক প্রমাণ করে উনি বলে উঠলো, 


আলিফ ঃ- আচ্ছা মুনমুন বিয়ে করে বউ নিয়ে শশুরবাড়ি যাওয়ার সময় যদি বউ প্রশ্ন করে যে আমি বিয়ে করেছি কিনা! তাহলে কি কেউ না হেসে পারে বলো?


উনার এমন শান্ত সুরে কথা বলা দেখে আমি সাহস করে প্রশ্ন করলাম, 


মুনমুন ঃ- আমি না ওই আপুটাকে কি বিয়ে করেছেন?


আলিফ এতো সময় পর বিয়ে করেছেন প্রশ্নটার মানে বুঝতে পারলো। তারপর কিছু বলতে যাবে এমন সময় উনার ফোনটা বেজে উঠলো।  উনি ফোনটা বের করে নম্বরটা দেখে রিসিভ করলেন। আমাকে এক আঙ্গুল দেখালেন। মানে বোঝাতে চাচ্ছেন যে এক মিনিট আমি কথা বলে তোমাকে ব্যাপারটা বলছি। 


কথা শুনে মনে হচ্ছে উনার অফিসের কল। কিসব মিটিং ফিটিং এর কথা বলছে। আমার এইবার খুব বিরক্ত লাগছে। ফোনটা বাজার আর সময় পেলো না। মনের মধ্যে খচখচ করছে। না জানি উনি কি বলেন। আমার অস্থিরতা দেখে মনে হচ্ছে আমি উনার প্রেমে পড়ে গেছি। না হলে এতো চিন্তা হওয়ার তো কথা না। উনার এক মিনিট তিরিশ মিনিটেও শেষ হচ্ছে না। কিসব বকে যাচ্ছে তখন দিয়ে। আর ভালো লাগে না। 


আমি এখন অনেক বেশিই বিরক্ত হচ্ছি। সারা রাস্তা কি উনি এই ফোনেই বকবক করে কাটিয়ে দিবেন? ফোনটা বের করে ফেসবুক থেকে গল্প পড়া শুরু করলাম, বসে থাকতে আমার অনেক বেশিই রাগ হচ্ছে। 

একটা গল্প পড়া শুরু করলাম। স্বামী স্ত্রীর গল্প মনে হয়। আমার জীবনটাও তো গল্প তাই নয় কি! গল্পটা এমন--


বাসররাতে আমার স্বামী তার বুকের সাথে আমার হাতটা চেপে ধরে বললো


--" আমি কি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি? কখনো তোমার কাছে তোমার অতীত জানতে চাইবো না। শুধু তোমার ভবিষ্যৎটা সম্পূর্ণ আমার। 


আমি মুচকি হেসে বললাম ঃ- হুম আপনি পারেন আমাকে বিশ্বাস করতে।  আমি আপনার হক কাউকে দিবো না। আমি কি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি? 


--" হুম পারো। আমি তোমার বিশ্বাসে মর্যাদা রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। 


কথাগুলো বলার সময় আমাদের দুইজনের চোখ পানিতে ভিজে যাচ্ছিলো। সে আমার চোখ মুছে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।  কিছু সময় পর আমি জানতে চাইলাম আপনি চোখের পানি মুছুন। 


সে হেসে বলেছিলো ঃ- এই চোখের পানি মোছার দ্বায়িত্ব তোমার। 


--" আমি কখনো আপনার চোখে আমার জন্য পানি আসতে দিবো না। 


--" আমিও দিবো না। 


সেদিনের পর থেকে রোজ রাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার স্বামী বলতো --" আমি বিশ্বাস করি তোমায়। আমিও তার কথায় মুচকি হাসি দিতাম। 

একদিন খেয়াল করলাম সে কয়েকটা কাগজ নিয়ে পড়ে আর মুচকি মুচকি হাসে।  কিন্তু এই মোবাইল ফোনের যুগে কি কেউ লাভলেটার দেয় নাকি? আমি আসলেই কাগজগুলো লুকিয়ে ফেলে। কেমন একটা সন্দেহ তৈরী হলো। তাহলে কি এখন চিঠির মাধ্যমে প্রেম করেন উনি। তাই যদি না হয় তাহলে আমায় দেখলেই কেন সে কাগজগুলো লুকিয়ে রাখবে। লুকিয়ে খেয়াল করে দেখলাম সে কাগজগুলো ম্যানিব্যাগে রেখে দেয়৷

গোসল করতে বাথরুমে গেলে লুকিয়ে কাগজগুলো বের করতেই আমার চোখ কপালে উঠলো। কি সুন্দর প্রেমের বানী লিখে রেখেছে। রাগের থেকে কষ্টই বেশি হচ্ছিল।  হঠাৎ খেয়াল করলাম হাতের লেখাটা আমার৷ একমিনিট এইগুলো তো আমার ডাইরির পেজ। তার মানে উনি আমার ডাইরি থেকে সব পেজ ছিড়ে নিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে ডাইরি বের করে দেখলাম তাতে একটা লেখা পেজও আর নেই। সব ছিড়ে নিয়ে গেছে। বাথরুম থেকে বের হয়ে সে এই অবস্থা দেখে কি করবে বুঝতে পারছিলো না। আমি ততো সময় রেগে ফুলে বেলুন হয়ে গেছি। পরিস্থিতি সামাল দিতে সে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো


--" আসলে এতো সুন্দর কথা আমাকে নিয়ে লেখেছো যে সবসময় পড়তে ইচ্ছে করে তাই ছিড়ে নিয়েছি তুমি রাগ করো না৷ সবসময় তো তোমার সাথেই থাকতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারি না তাই নিয়েছি তুমি রাগ করো না সোনাবউ আমার৷ 


আমি রাগ দেখিয়ে চলে গেছিলাম।  বিকালে অফিস থেকে ফেরার সময় ফুচকা চটপটি আইসক্রিম চকলেট গোলাপফুল আর বেলিফুলের মালা নিয়ে এসেছিলো৷ বোকা হাসি দিয়ে বললো


--" তোমার কি পছন্দ তাতো জানি না তাই সব নিয়ে এলাম। তুমি আবার পছন্দ জানি না বলে রাগ করো না কিন্তু। তাহলে এখন আমি কিন্তু কান্না করবো। 


তার কথাশুনে আমি ফিকফিক করে হেসে দিলাম। সে মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুদিন পর আমার ফোনে অচেনা একটা নম্বর দিয়ে কল আসলো সে পাশেই বসা ছিলো। আমি অনেক দ্বিধা নিয়ে কলটা রিসিভ করে লাউডস্পিকারে দিয়ে রাখলাম। ওপাশ থেকে মা কথা বলছে।  কথা শেষে সে মুচকি হেসে বললো


--" আমি পাশে থাকলে লাউডস্পিকারে দিয়ে কথা বলার দরকার নেই। আমি বিশ্বাস করি তোমায়। 


--" সবাই ভালোবাসি বলে আর আপনি বিশ্বাস করি বলেন কেন?


--" ভালোবাসার রং বদলে যেতে পারে কিন্তু বিশ্বাস বদলায় না হয়তো ভেঙে যায় নয়তো অক্ষত থাকে। আর ভালোবাসি কথাটা প্রমাণ করা অনেক কষ্টের আর বিশ্বাস করা প্রমাণ করা কিছুটা সহজ। ভালোবাসার প্রথম স্তর হলো বিশ্বাস।  বিশ্বাস না থাকলে কখনো ভালোবাসা থাকে না৷ তোমাকে যদি অন্য ছেলে বলে ভালোবাসে তোমায় তখন তোমার মনে হবে আমি বিশ্বাস করি তোমায়। কারো সাথে ঘনিষ্ঠ হতে গেলেও এটা মনে পড়বে। 


 কিছুদূর পড়া শুরু করে পারলাম না। রাস্তা শেষ। আলিফ আমার হাত ধরে নিয়ে বাস থেকে নেমে গেলো। উনার জ্বালায়  তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে গল্পটাও হারিয়ে গেলো। খুব রাগ হচ্ছে এখন। 









বাস থেকে নেমে একটা রিকশা নিয়ে বাড়িতে চলে আসলাম। আলিফ সত্যি খুব দায়িত্বশীল একটা মানুষ।  রিকশা খোঁজার সময় আমাকে গাছের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে রেখে গেছিলো। স্বামীদের এই সামান্য যত্ন নেওয়াটাও যেন অনেক কিছু। নিজের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে আমি আলিফের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি।  কিন্তু অনিশ্চিত জীবনে এমন প্রেম কি উচিত নাকি অনুচিত আমি জানি না। তবে আমার আলিফকে সত্যি ভালো লাগে। অনন্ত নিজের কাছে এমনটা লাগছে যে আমি আলিফের প্রেমে পড়েছি। আলিফ অবশ্য আমাকে আর ওই মেয়েটার ব্যাপারে কোনো কথাই বলেনি হয়তো এড়িয়ে গেছে। আমিও আর জানতে চাইনি। কেউ নিজে থেকে কিছু না বললে বারবার প্রশ্ন করা আমার মোটেও পছন্দ নয়। এটাকে অনেকে ইগো ভাবে। তবে আমি এমনটাই। বাড়িতে আসায় মা বাবা সবাই খুব খুশি। বাড়িতে আসার পর আলিফ সকলকে সালাম দিলো। তবে মুখে, আমরা অনেকেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি কিন্তু জানি না যে এটা উচিত কাজ নয়। 


বাড়িতে আসার পর আলিফ আমার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। মানে বিশ্রাম নিতে বলেছিলাম,  গিয়ে দেখি তিনি ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। আলিফকে ঘুমাতে দেখে আমি মায়ের কাছে গেলাম। আব্বু এই অসময়ে বাজারে দৌড়েছেন৷ নতুন জামাই এসেছে বলে কথা। আমি আমার পিতামাতার একমাত্র সন্তান।  তাই বাড়িতে আর কেউই নেই। মায়ের কাছে গিয়ে বসতেই মা নানান কথা শুরু করে দিলো। কেমন আছি, কেমন ওরা সকলে ইত্যাদি।  আমি অবশ্য মা'কে ওইসব কিছু বললাম না।  শুষ্ক হাসি হেসে বললাম,


মুনমুন ঃ- হুম আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। 


মা বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,


মা ঃ- তোর শাশুড়ী কোনো ঝামেলা করেনি তো আলিফের সাথে?


মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মা উৎসুক দৃষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু শাশুড়ী কেন আলিফের সাথে ঝামেলা হবে! আমাকে মেনে নেয়নি তাই কি! কিন্তু এটা মা কি করে জানলো? আমি বেশ হতবাক হয়ে মা'কে প্রশ্ন করলাম,


মুনমুন ঃ- আলিফের সাথে শাশুড়ী মা ঝামেলা কেন করবে?


মা আমার এমন প্রশ্নে অনেকটা দমে গেলেন। তারপর জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,


মা ঃ- নাহ কিছু না। 


আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম মা আমার থেকে কিছু লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু কি? সব কিছুই আমার কাছে রহস্য মনে হচ্ছে। আমিও কম নাছোড়বান্দা নয়। শেষ পর্যন্ত মা আমার কাছে সব বলতে বাধ্য হলো। কিন্তু মায়ের কথা শুনে আমি বরফের মতো জমে গেছি। আলিফ তাহলে এমনটা করেছে। মা কথাগুলো বলার সময় আলিফের প্রশংসা করতেই ব্যস্ত ছিলো। 


ব্যাপারটা হলো এমন,


বিয়ের দিন আলিফ জানতে পারে ওর বাড়ির লোক পাঁচ লাখ টাকা দাবী করেছে। কিন্তু আলিফ সরাসরি বলে দেয় সে যৌতুক নিয়ে বিয়ে করবে না। কোনো কথায় যখন কাজ হচ্ছিল না তখন আলিফই আব্বুকে  আব্বুকে বলে ওনাদের পুলিশের ভয় দেখাতে। আবার আলিফ নিজেই দেনমোহর পরিশোধ করে দিয়ে বিয়ে করে। আলিফের এমন গুন দেখে আমি গলে পানি হয়ে গেছি। কিন্তু এমনটা কেন করলো আলিফ? আমার আলিফের ব্যাপারে জানতে খুব ইচ্ছে করছে, আর ওই মেয়েটার ব্যাপারেও। 

তাই মায়ের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আলিফের কাছে গেলাম। নবাবজাদা এখনো ঘুমাচ্ছেন। আমার একটা অভ্যাস আছে, বাইরে থেকে আসলেই গোসল করতে হয়। নয়তো কেমন একটা লাগে, স্কুল কলেজ থেকে ফিরে গোসল করতাম ওই অভ্যাসটা রয়ে গেছে। আলমারি থেকে থ্রিপিস নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। অনেক দিন শাড়ি পড়েছি আর ভালো লাগছে না। শখ করে একদিন দুইদিন শাড়ি পরতে ভালো লাগে কিন্তু রোজ রোজ কি শাড়ি পরা যায় নাকি! গোসল সেরে বাইরে আসতে দেখলাম আলিফ ঘুম দিয়ে উঠে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখে কিছু সময় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলো তারপর সোজা বাথরুমে চলে গেলো। আমার ঘর আর ভাবটা এমন যেনো ঘরটা উনার! আলিফ ফ্রেশ হয়ো আসার পর মা রান্না ঘর থেকে ডাক দিলো। আব্বু রাতের জন্য বিরিয়ানি কিনে এনেছেন। সকলে মিলে রাতের খাওয়া শেষ করলাম। বাড়িতে আসার পর বেশ ভালো লাগছে। নিজের চেনা পরিবেশ,  নিজের ঘর। আলিফ আব্বু আম্মুর কাছে জামাই রাজা হয়ে গেছে মনে হয়। ওদের ভাব দেখে তা-ই মনে হলো। অবশ্য যে ছেলে শশুর বাড়ি থেকে কোনো টাকা না নিয়ে দেনমোহর পরিশোধ করে বিয়ে করো তার উপর যে কেউই গদগদ খাবে, এটাই স্বাভাবিক।

আলিফ খাওয়া শেষ করে আব্বুর সাথে কোথায় একটা গেলো, মনে হয় ঘুরতে গেছে। আব্বুর খাওয়ার পর একটু বাইরে যাওয়ার অভ্যাস আছে। 

মা অবশ্য এতো সময় ঘুমিয়ে গেছে। মা রাত খুব কম জাগতে পারে। কিছু করার না পেয়ে একটা গল্পের বই বের করলাম। কলেজ জীবন থেকে কয়েকটা বই কিনে রাখতাম ও-ই গুলোর একটা। কিন্তু পড়তে ভালো লাগছে না। মনের ভিতর খচখচ করছে। ওই মেয়েটা কে জানতে ইচ্ছে করছে অনেক। 


আচ্ছা ওই মেয়েটা যদি আলিফের বউ হয় তাহলে কি আমাকে ছেড়ে দিবে আলিফ। আর আলিফ যদি আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করে তাহলে আমার সাথেই বা আসলো কেন! আমাকে রেখে যেতে? কিছু ভালো লাগছে না এখন। 


এমন সময় আলিফ ঘরে আসলো। আলিফ একটু হেসে বললো,


আলিফ ঃ- এই নাও এইটা তোমার,


আমি ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা ছোট বেলি ফুল। একটাই! কিন্তু খুব সুন্দর। আমি ওর হাত থেকে মন মরা হয়ে ফুলটা নিলাম। আলিফ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তারপর জিজ্ঞেস করলো,


আলিফ ঃ- Any problem? 


সমস্যা তো আছেই কিন্তু কি বলবো উনি তো উওর দেয় না। তাও মুচকি হেসে বললাম, 


মুনমুন ঃ- মশারী টানাতে পারছি না।


আলিফ বেশ ভাব নিয়ে বললো,


আলিফ ঃ- Let you and me do it.


আমি বেশ রাগী গলায় বললাম, 


মুনমুন ঃ- আমি পারবো না। আপনি একাই করেন। 


খুব বিরক্ত লাগছে উনার ওপর। এখনো ওই মেয়েটার কথা কিছু বললো না। আলিফ একাই মশারী টানিয়ে আমাকে ডাকলো। আমাদের ভিতর কিছু না থাকলেও আমরা এক খাটে ঘুমিয়েছি সবদিন। বিছানায় যাওয়ার পর উনি বেশ সিরিয়াস হয়ে বললেন,


আলিফ ঃ- কোনো সমস্যা হয়েছে কি? এমন মন মরা হয়ে আছো কেন?


আমি আস্তে করে বললাম,


মুনমুন ঃ- আসলে আমি কিছু জানতে চাইলে আর কেউ সেই প্রশ্নের উত্তর না দিলে খুব রাগ হয় আর খারাপ লাগে তাই। 


আলিফ কিছু সময় চিন্তা করলো,  তারপর মৃদু হেসে বললো, 


আলিফ ঃ- তুমি বাসে ওই মেয়েটার কথা জানতে চেয়েছিলে। আমি এই পয়েন্টটা মিস করে গেছি। আচ্ছা শোনো-


ওইটা আমার খালাতো বোন। বিয়ের দিনে আসতে পারেনি তাই সেদিন এসেছিলো। তুমি হয়তো খেয়াল করবে মা কিছুই বলেনি সেদিন। ব্যাপারটা হয়েছে এমন, ও সাজতে খুব পছন্দ করে তাই বউ সেজেই চলে এসেছে। তার ভাষ্যমতে বিয়ের দিন সাজতে পারেনি তাই সেদিন বউদের মতো সেজে এসেছিলো। আর আমাদের সমাজের লোকজন তো খুব ভালো। একসাথে কাউকে দেখলেই মনে করে যে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে বউ বা প্রেমিকা। এসব ছাড়া মনে হয় পৃথিবীতে আর কোনো সম্পর্ক নেই। 

I don’t know whether they reads or not.


কথাগুলো বলে আলিফ বিরক্তি প্রকাশ করলো। আমার মনটা নিমেষেই ভালো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে অনেক বড় একটা পাথর মন থেকে নেমে গেলো। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে আলিফের দিকে তাকিয়ে আছি। আলিফ কিছু সময় চুপ থেকে আবারও বলতে লাগলো,


আলিফ ঃ- আসলে মুনমুন আমার বিয়েটা বাড়ি থেকে রোজ করে ঠিক করেছে। আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না। এমনটা নয় যে তোমাকে পছন্দ নয়৷ তবে মা বাবা যদি না জানিয়ে বিয়ে তারিখ নির্ধারণ করে আসে, তাহলে কি কারো ভালো লাগে বলো? আমি কখনো প্রেম করিনি।,  কোনো খারাপ কাজও করি না তাও যখন আম্মু আব্বু এমনটা করলো আমি ঠিক মেনে নিতে পারিনি। তুমি আমাকে একটু সময় দেও। আমি সবটা গুছিয়ে নিবো। এই কয়েকদিনে যা বুঝলাম তুমি খুব ভালো মেয়ে। আল্লাহ আমাকে অনেক ভালোবাসেন তাই তোমাকে স্ত্রী হিসাবে আমাকে দিয়েছেন। 


অনেক আবেগ নিয়ে উনি কথাগুলো বলছিলেন। উনার শেষ কথাগুলো শোনার পর আমার বেশ লজ্জা লাগছে তাই চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। তারপর বালিশে মুখ গুঁজে রাখলাম। আলিফ হয়তো বিঝতে পারলো আমি বিব্রত হচ্ছি তাই সেও চুপচাপ শুয়ে পড়লো। আসলেই আমাদের সমাজে এমন লোক আছে যারা নিজেরাই ছেলে মেয়েদের নিজেদের পছন্দ মতো বিয়ে দেয়৷ কিন্তু তারা ভুলে যায় জীবনটা উনাদের নয়৷ যার সাথে যে মানুষটা সারাজীবন থাকবে তাদের নিজেদেরও কথা বলে নেওয়া উচিত। 


নানান কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম জানি না। সকালে চোখ খুলতেই দেখি আলিফ আমার বেশ কাছাকাছি এসে ঘুমিয়ে আছে। একদম আমার বালিশে। সাথে আমার কাঁথাটাও দখল করে নিয়েছে। আলিফের নিশ্বাস আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি। আমার অবাধ্য চোখ জোড়া আলিফকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে আছে। কিছু সময় পর আলিফ চেখ খুললো৷ আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি৷ এটা দেখে ওর কোনো সমস্যা হলো না৷ তবে আমি বেশ লজ্জা পেলাম। 


আলিফও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছু সময় পর আলিফ মুচকি হেসে বললো, 


আলিফ ঃ- ঘুম থেকে উঠলে তোমাকে বাচ্চাদের মতো লাগে। মুখটা ফুলে যায়৷ বেশ সুন্দর তুমি। আমি তোমার সৌন্দর্য খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে চাই৷ 


কথাটা বলে আলিফ ওর ঠোঁট জোড়া আমার কপালের কাছে নিয়ে আসলো। এদিকে আমার হার্ট মনে হয় ড্রাম বাজানোর কম্পিটিশন দিচ্ছে। জোরে জোরে লাফাচ্ছে। মনে হয় এখনই হার্ট ফেটে যাবে। আলিপ ওর ওষ্ঠ আমার কপালে স্পর্শ করলো।  আমি বেশ লজ্জা পেয়ে সেখানে থেকে প্রায় দৌড়ে চলে আসলাম। সকাল থেকে আমি আর আলিফের আসেপাশে যাইনি। খুব লজ্জা লাগছে আলিফকে দেখলে। আলিফও আমাকে আর ডাকেনি। হয়তো ভেবেছে আমি লজ্জা পাচ্ছি। সকালের খাওয়ার পর বাগানে গেলাম। হাঁটার সময় কেউ একটা আমার হাত ধরে হেঁচকা টানে তার খুব কাছে নিয়ে আসলো। আমাকে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে আছে। ভয়ে হাত পা কাঁপছে  তবুও আস্তে আস্তে চেখের পাপড়ি খুললাম। কিন্তু চোখের সামনে যে মুখটা দেখলাম তাতে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এ কাকে দেখছি আমি?








আলিফ আমাকে এইভাবে টেনে নিয়ে আসবে আমি ভাবতেই পারিনি। কেমন যে লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না। আলিফ শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুসময় অতিবাহিত হবার পর আলিফ নিজে থেকেই বলে উঠলো,


আলিফ ঃ- কি হয়েছে? সকাল থেকে কোনো খোঁজ নেই কেন? আমার উপর কি তুমি রেগে আছো?


নেও ঠেলা!  কি জবাব দিবো আমি? তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, 


মুনমুন ঃ- আসলে তেমন কিছু নয়। ওই আমি...


আলিফের শান্ত দৃষ্টি ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে। মনে হয় রেগে যাচ্ছে। কি করবো এখন! উনি রেগে যাচ্ছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কারণ উনি আমার হাতটা ক্রমশ শক্ত করে চেপে ধরছে। ভয়ে লজ্জায় আমি কুঁকড়ে যাচ্ছি। এতো রেগে যাওয়ার কি হলো কে জানে!


আলিফ ঃ- আমি কিছুই চিনি না, আর তুমি একা ঘুরে বেড়াচ্ছ?  ব্যাপারটা কি উচিত বলো?


এইবার আমার খুব কান্না পাচ্ছে। দেওয়ালের সাথে আমাকে খুব শক্ত ভাবে চেপে ধরে আছে৷ পিঠে লোহার মতো কিছু একটায় খোঁচা লাগছে। খুব বেশি ব্যাথা করছে। আমার চোখে পানি দেখে উনি অবাক হয়ে গেলেন। বেশ ব্যস্ত হয়ে বললেন,


আলিফ ঃ- কি হলো তোমার? কাঁদছো কেন?  সরি আমি তো মজা করছিলাম। কিছু মনে করো না। আসলে সকালের পর থেকে তুমি আমার আশপাশেও যাওনি৷ তার জন্য একটু রাগ হয়েছিলো। আমার এমনটা করা উচিত হয়নি৷ I am extremely sorry.


এই লোক তো একা একাই বকবক করে যাচ্ছে। আমার কোনো কথা শোনারই নাম নেই। আমি আস্তে করে বলে উঠলাম,


মুনমুন ঃ- আমার কিছু হয়নি, মানে আমি রাগ করিনি। দেওয়ালের থেকে কিছু একটা পিঠে ফুটছে মনে হয়৷ 


আলিফ বেশ ব্যস্ত হয়ে আমাকে পিছন দিকে ঘুরিয়ে দিলো। পিঠের ক্ষত জায়গাটায় হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কেমন ক্ষত হয়েছে। আমারও বেশ ব্যাথা লাগছে। এইবার আলিফ সত্যি অনেক বেশি রেগে গেলো৷ তারপর ধমকের সুরে বললো,


আলিফ : এতো সময় বলনি কেন? অনেকটা কেটে গেছে, এসো ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। বাড়িতে ঔষধ আছে তো?


আমি উপর নিচে মাথা নেড়ে বললাম যে আছে। উনি বেশ তাড়াহুড়ো করে আমাকে কোলে তুলে নিলো। এটা কেমন হলো! কেটেছে পিঠে, কোলে নেওয়ার কি আছে বুঝলাম না৷ আমি বলে উঠলাম, 


মুনমুন : আরে আমার পিঠে কেটেছে,  পা তো ঠিক আছে। আমি হেঁটেই যেতে পারতাম তো। 


আমার কথায় উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু কিছু বললো না।

কি খেলে মানুষ কতায় কথায় রাগ করে কে জানে! উনি আমাকে কোলে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। তারপর ঔষধ খুঁজতে লাগলো। আমি বললাম,


মুনমুন : ঔষধ ড্রয়ারে ভিতর আছে। 


উনি কথায় জবাব না দিয়ে ঔষধ নিয়ে আসলেন। তারপর রাগী গলায় বলে উঠলো, 


আলিফ : কি হলো? জামাটা খোলো না হলে কি করে ঔষধ লাগবো?


এ কেমন জ্বালা! উনার সামনে আমি জামা খুলবো নাকি! কাল কোন দুঃখে যে থ্রিপিস পরতে গেছিলাম কে জানে! আর কিসব বলছে উনি! উনার কি কোনো লজ্জা নেই নাকি! আমি কাঁপা গলায় বললাম,


মুনমুন : না, আমি জামা খুলবো না। আপনি আমাকে দিন আমি লাগিয়ে নিবো। 


আলিফ কিছু না বলে ঘরে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো।  তারপর উনার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা খুঁজে পেয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। কাঁচি দিয়ে উনি কি করবেন?

আমাকে খুন করবেন নাকি! কাচি দিয়ে কি মানুষ খুন করা যায়? আমি কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমাকে পিছন দিকে ঘুরিয়ে দিলো। তারপর উনি ক্ষত জায়গার আশেপাশে বেশ খানিকটা জামা কেটে ফেললেন। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,


মুনমুন : এটা আমার সব থেকে পছন্দের জামা!  আপনি এইভাবে কেন কেটে ফেললেন?


উনি এমন একটা ভাব নিলেন যেন কিছুই হয়নি। আমি উনার বাহুর কাছের শার্ট খামছে ধরলাম। তারপর রাগী গলায় বললাম,


মুনমুন : কেন এমন করলেন? আমার পছন্দের জামা কেটে কেন ফেললেন?


উনি আমাকে আবারও পিছনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে কাটা জায়গাটা ব্যান্ডেজ করে দিলেন। তারপর সিরিয়াস হয়ে বললেন,


আলিফ : রেডি হয়ে এসো। তোমাকে একটা ইনজেকশন করিয়ে নিয়ে আসি।


আমি ছোটবেলা থেকেই সুই খুব ভয় পাই না। এখন ইনজেকশন করতে গেলে তো, ওরে বাবা না আমি কিছুতেই যাবো না৷ একটুও না। আমি তড়িঘড়ি করে বললাম,


মুনমুন : আমি যাবো না। 


আলিফ আমার দিকে এমন ভাবো তাকালো যেন আমাকে ভস্ম করে দিবে। কিছু না বলে রেডি হয়ে নিলাম। কি যন্ত্রণা!  উনার সাথে চুপচাপ কথা না বলে হেঁটে যাচ্ছি। বাড়ি থেকে দুই মিনিট পর একটা ঔষধের দোকান। সেখানেই গেলাম আমরা। তারপর একটা টিটেনাস ইনজেকশন করলাম। পুরোনো লোহা টিন এসব কিছুতে কাটলে ইনজেকশন করতে হয়! আর ভালো লাগে না।


ইনজেকশন পুশ করার সময় আমি আলিফের হাত ধরে ছিলাম। আলিফ অবশ্য এইসব নিয়ে কিছু বলেনি। বাড়ি আসার পথে আলিফ আমাকে বাড়ির সামনে রেখে কোথায় একটা চলে গেলো। আমি জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বড় বড় পা ফেলে উধাও হয়ে গেলেন। পিঠে একটু ব্যাথা করছে। ওই দোকানদার কাকু আবার কতগুলো ঔষধও দিয়ে দিয়েছে। যত্তসব ফাউল!  আমার ঔষধ খেতে একদমই পছন্দ না।


ঘরে ঢোকার সময় মায়ের সাথে দেখা হলো। মায়ের সাথে পাশের বাড়ির ভাবিও আছে। আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। মাও বেশ খুশি হয়ে আছে। কিন্তু কেন? ভাবি আমাকে দেখে বলে উঠলো, 


ভাবি : ননদী তো আজ কাল হাঁটতেই পারে না৷ বরের কোলে উঠে ঘুরতে হয়। 


এতো সময় পর বুঝলাম৷ আমাকে দেখে হাসার কারণ কি! এই আলিফের বাচ্চাকে নিয়ে আর পারি না। এখন আমারই লজ্জা পাওয়া লাগছে। কোনো কথা না বলে চুপচাপ রুমে চলে এলাম। তারপর আলিশাকে কল দিয়ে সবকিছু বললাম। নেও উনিও এখন হাসছে। আর বলছে,


আলিশা : ভাইয়া ভাবির প্রেমে পড়েছে।


আলিশার সাথে কথা বলা শেষ করে মায়ের কাছে গেলাম৷ মা হাসি মুখে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মা বাবা সন্তানের সুখেই খুশি থাকে। দুপুরের পরে আলিফ একগাদা কাপড় কিনে বাড়িতে ফিরলো।


মা আব্বুর জন্য আর একদম আমার পছন্দের জামাটার মতো একটা জামা। আমি জামাটা দেখে খুব খুশি হলাম। তারপর উনাকে প্রশ্ন করলাম, 


মুনমুন : কোথায় পেয়েছেন?  একদম এক রকম তো।


আলিফ কিছু না বলে মুচকি হাসলো। এই ছেলের হাসি দেখে তো আমার হার্ট বিট মিস হবে সিওর। উনি সুপরিকল্পিত ভাবে আমাকে মারতে চাইছে হুহ। সেদিনটা বেশ ভালোই কেটে গেলো। ঔষধের প্রভাবে পিঠের ব্যাথাটাও কমে এসেছে। 


পরেরদিন সকালে আলিফ আমাকে ডেকে নিয়ে বললো,


আলিফ : মুনমুন আজ আমাকে ফিরতে হবে। অফিস থেকে জরুরি কাজে ডেকেছে। তুমি চাইলে থাকতে পারো তবে আমি তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে চাই।


কি সুন্দর বুদ্ধি উনার! সাথে নিয়ে যেতে চাই। যত্তসব!  এখন চলো উনার সাথে। সকালের খাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে নিলাম। মা আব্বু অনেক থাকতে বললো কিন্তু আলিফ তাদের বুঝিয়ে বললো ছুটি পেলে আবার নিয়ে আসবে। সকলকে বিদায় জানিয়ে আমারা রওনা দিলাম। 


বাসের ভিতর আমি জানালার পাশে বসলাম। রাতে ঘুম কম হওয়ার জন্য কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম জানি না। চোখ খুলে দেখলাম আমি আলিফের ঘাড়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছি। আমাকে উঠতে দেখে আলিফ মুচকি হেসে বললো, 


আলিফ : ঘুম ভেঙেছে তাহলে?


আমি নিঃশব্দে মাথা নাড়লাম।


চলবে।


(সরি ছোট হয়ে গেছে। তবে আমি অনেক অসুস্থ তাই লিখতে পারিনি। কেউ রাগ করবেন না হুহ)#ননদিনী 

#ফারহানা_কবীর_মানাল 

শেষ পার্ট 


আলিফ খুব যত্ন করে আমাকে বাস থেকে নামতে সাহায্য করলো। এই সামান্য কেয়ার টুকু যে মেয়েদের মনে কি রকম প্রভাব ফেলতে পারে তা আজ আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। আলিফ বাড়ির সকলের জন্য কিছু খাবার কিনে নিলো। আমি উনার কাজে বেশ অবাক হলাম। 


উনি অবশ্য আমাকে তেমন কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। একটা রিকশা ডেকে তাতে চড়ে বসলেন আমাকে নিয়ে। আমি মন খারাপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। কেন যে রাগ হচ্ছে বুঝতে পারছি না। উনি খাবার কেনার সময় আমাকে কিছু বলেনি তাই হয়তো। রিকশার উঠার পর বললেন, জানো মুনমুন আমি বাড়ি থেকে কোথাও গেলে সাথে কিছু নিয়ে ফিরি। এতে করে বাড়ির সকলেই খুশি হয়। তেমন একটা টাকা তো খরচ হয় না। 


আমার মুখে নিমেষেই এক চিলতে হাসি দেখা দিলো। আলিফ কি আমার মনের কথা বুঝতে পারে? সত্যি প্রথম প্রেমে পড়ার অন্যরকম অনুভূতি আর তা যদি হয় হালাল তাহলে তো কথাই নেই। বিয়ের আগে কোনো সম্পর্কই পবিত্র হয় না৷ হারাম কোনো কিছুই আসলে পবিত্র হতে পারে না। 


আমি মুচকি হাসছি দেখে আলিফ আমার হাতটা উনার হাতের ভিতর আবব্ধ করে নিলো। তারপর মুচকি হেসে বললো, কি হলো হাসছো যে?


আমি মুখে কিছু না বলে ডানে বায়ে মাথা নাড়লাম। আলিফ আর কিছুই জানতে চাইলো না৷ সারা পথ উনি আমার হাত ধরে ছিলো। আমি অবশ্য নিষেধ করিনি কারণ আমার নিজেই খুব ভালো লাগছিলো। আলিফেরও হয়তো ভালো লাগছিলো না হলে সারাপথ কি কেউ হাত ধরে থাকে নাকি!


বাড়িতে আসতেই আলিশা দৌড়ে এলো। শাশুড়ী মা-ও এলেন, শশুর আব্বু এখন বাড়িতে নেই। শত হলেও নিজের ছেলের উপর কি কেউ রাগ করে থকতে পারে। আপু নাকি ও-ই দিনের পরেরদিনই ফিরে চলে গেছে। লোকেরা তাকে নিয়ে নানান কথা বলছিলো। আসলে এইসব লোকেদের কোনো কাজ নেই মনে হয়। কার সাথে কি সম্পর্ক না জেনেই সমালোচনা করতে থাকে। 


আমাদের দেখে আলিশা মুচকি হেসে বললো,  কি রে ভাইয়া? ভাবিকে পেয়ে বুঝি আমাকে ভুলে গেলি হু! এখন তো তোর মনেই থাকে না আমার কথা। 


আমি ওর এমন কথায় বেশ অবাক হলাম। আলিশা তো এমন মেয়ে নয়। বিয়ের পর থেকে আলিশাই আমাকে সব থেকে বেশি সাপোর্ট করেছে এই বাড়িতে যা আমি আলিফের থেকেও প্রথম দিকে পাইনি। আলিফ মুচকি হেসে খাবারের প্যাকেটটা আলিশার হাতে দিলো। আলিশা সেখান থেকে একটা বের করে আমার মুখের সামনে ধরে বললো, এই নেও খাও তুমি। আমি তাড়াতাড়ি ফুফু হতে চাই,  তাই ঘুস দিচ্ছি। আমি ভেবেছিলাম তোমার বর হয়তো আমার জন্য কিচ্ছু আনেই নি। এইটার অর্ধেক তুমি খাও আর বাকিটা ভাইয়াকে খেতে বলো। ভালোবাসা বেড়ে যাবে হিহি।


আলিফ আলিশার দিকে একটু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।  আলিশার তাতে কোনো পরিবর্তন হলো না। সে আমাদের খাইয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্য ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে বলেছে। শাশুড়ী মা রান্নাঘরে কিসব করছে। আমি ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর রান্না ঘরে গিয়ে শাশুড়ী মা-কে বললাম, মা কোনো কাজ করা লাগলে আমার কাছে দেন আমি করছি। 


শাশুড়ী মা রাগী গলায় বললো,  আমাকে এতোটা খারাপ ভাবারও দরকার নেই। এতোদূর থেকে ফিরে এখনই নতুন বউকে দিয়ে রান্না করাবো এতোটাও খারাপ শাশুড়ী হয়ে যায়নি আমি। ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেওয়া হোক।


উনার কথায় আমার বেশ হাসি পেলো। আমাকেই কথাগুলো বলছে তবে সোজাসাপটা ভাবে না। কি লোক রে বাবা। রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরে চলে এলাম। আলিফ তখন খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। আমি দেখে মুচকি একটা হাসি দিলো। কি লোক কে জানে! এমনই আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি আর এখন এমন হাসি দিলো তো পাগল হয়ে যাবো। আমিও খাটে গিয়ে বসলাম। 


আলিফ কিছু একটা ভেবে ফট করে আমার হাত ধরে ফেললো। এমন কাজে আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। তারপর শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। উনার চোখের দিকে তাকানো আমার জন্য মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। কিছুসময় পর আলিফ নিজেই বলে বসলো, দেখো মুনমুন তুমি খুব ভালো সুন্দর একটা মেয়ে। আমার তোমাকে পছন্দ হয়নি এমনটা নয়। আসলে মা আব্বু আমাকে না জানিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলবে আবার তোমাদের কাছে টাকাও দাবী করবে, এমনটা আমি ভাবতে পারিনি। আম্মু আব্বু কখনো আমাদের এমনটা শিক্ষা দেয়নি ,  উনারা যে কেন এতো বদলে গেলো কে জানে! তবে উনারা সত্যি খুব ভালো। তুমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে মা আব্বু কেমন।  আমি এতোদিন তোমাকে স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার দেয়নি কারণ আমি কিছুতেই এটা মানতে পারছিলাম না।  তুমি আমাকে দয়া করে মাফ করে দেও। আর আমাকে একটু সময় দেও। আমি ঠিক সবকিছু মেনে নিবো। 


করুণ চোখে আলিফ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি তো কেউ যদি না জানে যে তার বিয়ে তাহলে তো রাগ করাই স্বাভাবিক। আমি আলিফের হাতের উপর আমার অন্য হাতটা রাখলাম। স্ত্রী তার স্বামীকে আস্বস্ত করছে, এর থেকে ভালো কিছু কি আর হতে পারে? হয়তো না।  আবার হতেও পারে আমি জানি না। 


আমি আলিফের হাতের উপর হাত রাখার পর উনি আমাকে বেশ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আমার খুব ভালো লাগছে তবে হার্টটা একটু জোরে জোরে ড্রাম বাজাচ্ছে এই আর কি! কিছু সময় পর আলিফ বললো, তুমি একটু ঘুমিয়ে পড়ো দুপুরে উঠে গোসল করে নিও। রোদ থেকে এসেই গোসল করলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে । আমি মুচকি হেসে বালিশে মাথা এলিয়ে দিলাম। কখন যে ঘুম চলে এলো নিজেই বুঝতে পারলাম না। 


ঘুম ভেঙে দেখলাম আমি কারো বাহুর মাঝে খুব দৃঢ় ভাবে আবদ্ধ হয়ে আছি। আর এই বাহুর মালিক আলিফ ছাড়া কেউ নয়। স্বামী স্ত্রী এমন কাছাকাছি থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমি নড়বার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোনো লাভ হলো না৷ বাধ্য হয়ে ওইভাবে শুয়ে থাকতে হলো। চোখ জোড়া আবারও বন্ধ করে নিলাম। কারো ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ কপালে লাগতেই চোখ মেললাম। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। আলিফ মুচকি হেসে বললো, যাও গোসল করে এসো। তারপর আমি যাবো।


আমি তড়িঘড়ি করে বলে ফেললাম,  না।


আলিফ শয়তানী হাসি দিয়ে বললো, তাহলে তুমি কি চাও একসাথে গোসল করতে? 


আমি রাগী চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনার দিকে তাকাতেই উনি চোখ মারলেন। মানে এক চোখ বন্ধ করে আবার খুললেন। ধূর আমার এখন লজ্জা লাগছে।  দৌড়ে একটা শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেলাম। উনি যে এতো লজ্জা দিতে পারে আমি একটুও বুঝতে পারিনি। 


গোসল করার পর খেয়াল করলাম আমি শুধু শাড়ি নিয়ে এসেছি।এখন কি করবো? গা মোছার জন্যও তো কিছু একটা লাগবে নাকি! দরজা খুলে যদি দেখি উনি হুলো বেড়ালের মতো ওত পেতে বসে আছে৷ এই না খুবই লজ্জার ব্যাপার হয়ে যাবে। ভিজা শরীরেই শাড়িটা পেচিয়ে নিলাম। দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখলাম উনি সেই বসেই আছে। আয়নাতে খেয়াল করলাম আমার শাড়ি লেগে লেগে আছে। মানে কিছু জায়গা ভিজে গেছে আর কি! আলিফ হঠাৎ করে আমার দিকে এগিয়ে আসলো। আমি পিছন দিকে যেতে যেতে দেওয়ালে আটকে গেলাম। উনি খুব যত্ন করে আমার কপালে লেগে থাকা চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দিলেন। তারপরচোখের পাপড়ির উপর চুমু খেলেন। আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। উনার নিশ্বাস আমার মুখের উপর পড়ছে। আলিফ নিজের ঠোঁট জোড়া ক্রমশ আমার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে আনছে৷ একসময় তার দূরত্ব শূন্যে গিয়ে ঠেকলো। এটা কেমন অদ্ভুত অনুভূতি আমার জানা নেই৷ তবে আমি আলিফকে এইভাবেই কাছে পেতে চাই। হয়তো এর থেকেও ঘনিষ্ঠ ভাবে! কিছুসময় পর আলিফ আমাকে ছেড়ে দিলো৷ তারপর কপালে চুমু দিয়ে বললো, শাড়িটা পাল্টে নতুন শাড়ি পরো আর গা মুছে ফেলো।  ঠান্ডা লাগবে। 


আমি মুখ ফসকে বলে ফেললাম, এতো সময় আর ঠান্ডা লাগেনি মনে হয়। 


আলিফ কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। আমিও ফ্রেশ হয়ে নিচে গেলাম। শশুর আব্বু সন্ধ্যার আগে বাড়িতে আসবেন না। শাশুড়ী মা আর আলিশা খাবার সাজিশে রাখছে দুপুরের জন্য। আমিও ওদপর সাথে হাত লাগালাম। আলিফ গোসল শেষ করে একটা কালো টি-শার্ট পরে বাইরে এলো। উনাকে খুব সুন্দর লাগছে। দেখতেও ইচ্ছে করছে তবে লজ্জায় তাকতে পারছি না। 


আলিফ আমার অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। আলিশা ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বললো, মা দেখো তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে ভাবির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। শাশুড়ী মা রাগী চোখে আলিশার দিকে তাকলো। আলিশা ভেংচি কেটে খাওয়ার দিকে মন দিলো। 


আলিফ বেশ ভাব নিয়ে বললো, জানো মা ভেংচি কাটে বাদরে। হা হা। লেজ ছাড়া বাদররাও ভেংচি কাটে।


শাশুড়ী মা রেগে বললেন,  তোদের কতবার বলতে হয় যে মানুষকে কোনো পশুর নামে ডাকতে হয় না। আল্লাহ মানুকে আশরাফুল মাকলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব বানিয়েছে। কাউকে এসব বলে ডাকলে আল্লাহর রাগ করেন। কেয়ামতের দিন যদি আল্লাহ প্রশ্ন করে তুমি আমার বান্দাকে এসব নামে কেন ডেকেছো? আমি কি তাকে কুকুর বা কোনো পশু হিসাবে সৃষ্টি করেছি? তখন কি জবাব দিবি তোরা?


আলিফ কিছু না বলে খেতো লাগলো। শাশুড়ী মা তো বেশ ধার্মিক আছে। খাওয়া শেষ করে আলিশার সাথে ছাঁদে গেলাম। সারা বিকাল আলিশার সাথে গল্প আর দুষ্টুমি করে কাটলো। নতুন হলেও কত সহজে আমি এদের সাথে মিশে গেছি। খুব ভালো লাগছে। ওইবাড়ি থেকে ফিরেই মা কে কল করে বলেছিলা আমারা আল্লাহর রহমতে সুস্থ ভাবে পৌঁছাতে পেরেছি। আলিশা সত্যি খুব ভালো একটা মেয়ে অনেক মিশুক। আলিফ বেশ কয়েকবার ছাঁদে এসে দেখে গেছে তবে আমাকে ডাকতে পারেনি। 


সন্ধ্যার দিকে আলিফ মসজিদে নামজ পড়তে গেলো। আমরাও সকলে নামাজ শেষ করলাম। শশুর আব্বু নামাজের একটু পর বাড়িতে ফিরলেন। আমি তাকে সালাম দিলাম। সে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো। তারপর হাসি মুখে বললো, তোমাদের বাড়ির লোকেরা কেমন আছেন?


আমি জবাবে বললাম,  আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন? আপনার শরীর ঠিক আছে তো?


উনি মাথা নেড়ে জবাব দিলেন। তারপর ঘরের দিকে চলে গেলেন। আমিও ঘরে এসে বসে কি করবো ভাবতে লাগলাম। সকলের জন্য চা বানালে মন্দ হয় না। গরম গরম চা এখন খেতে বেশ ভালোই লাগবে। কথাটা মাথায় আসতেই রান্না ঘরে চলে গেলাম। রান্না ঘরের পাশের ঘরটাতে শশুর আব্বু ও শাশুড়ী মা থাকেন। রান্না ঘর দিকে ওই ঘরের কথা স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায়। চা বানানোর সময় কানে এলো আলিশা ও আব্বু কথা বলছে। আব্বা চুপই আছে, আলিশা উনাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলেছে,


স্বাভাবিক সুরেই আলিশা বলে চলেছে, আব্বু তুমি আমাদের সবসময় মিলে মিশে থাকতেই শিক্ষা দিয়েছো। আমি সেদিন সকলের সামনে তোমাকে অপমান করতে ওই কথাগুলো বলেনি। আসলে আব্বু প্রথম দিকে ব্যবহারটাই মানুষের প্রতি ধারনার সৃষ্টি করে। তুমি নতুন বউকে রেখে আমাকে শাড়ি দিয়েছো। হয়তো ভেবেছো ভাবি অনেক শাড়ি পেয়েছে আমার হয়তো খারাপ লাগছে কিন্তু না। বিয়েতে তো অনেক শাড়ি পাবে এটাই স্বাভাবিক। শত শাড়ি থাকলেও পার্থক্য কিন্তু থেকেই যায়। ভাবির মনে এটা গেঁথে যাবে যে তুমি সে নতুন বউ থাকা অবস্থায় তাকে বাদ দিয়ে আমাকে শাড়ি দিয়েছো। আর যে সব লোক আমাকে তোমার কাছে খারাপ বানাচ্ছিল তারই ভাবির কাণে কথাটা বিষিয়ে দিতো, ওরাই কথাটা তুলতো। দেখো আব্বু আমি সারাজীবন এই বাড়িতে থাকবো না। একটা মেয়ের জন্য এটাই স্বাভাবিক। চাইলেও তোমাদের সেইভাবে খেয়াল রাখতে পারবো না। ভাবিই তোমাদের দেখাশোনা সেবাযত্ন ইত্যাদি করবে। ভাবি কি চাইলেও তার মা-বাবাকে এখানে এনে রাখতে পারবে? বা তারাও  এখানে আসতে চাইবে না। তেমন তোমরাও। ভাবওর সামনে ওইভানো শুধু আমাকে শাড়ি দেওয়াটা কি উচিত ছিলো? আমি অন্যায় ব্যবহার করেছি তোমার সাথে, আমার জন্য তুমি লোকের কাছে কথা শুনেছো। আমি তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী! 


একটা মেয়ে কি করে এতটুকু বয়সে এতেটা বুঝতে পারে আমি জানি না। তবে এই সামান্য ব্যাপারটা অনেক বয়সের লোকেরাও বুঝতে পারে না। এতোসময় চা হয়ে গেছে। চা নিয়ে ওই ঘরে গেলাম। দেখলাম শশুর আব্বু আলিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে, আমার সেই ছোট্ট মেয়েটা কবে এতো বড় হয়ে গেলো।


আব্বুর চোখে পানি তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।  আমি অনুমতি নিশে ঘরে প্রবেশ করলাম৷ যে কারো ঘরে ঢোকার আগে অনুমতি নিতে হয় এটাই ইসলামের নিয়ম।  কিন্তু আমারা তেমনন কেউই এটা মেনে চলি না। 


শশুর আব্বু চা পেয়ে খুব খুশি হলেন। চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা মুছে নিলেন তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আমার আজ সত্যি খুব ভালো লাগছে। এমন সময় আলিফ বাড়িতে এলো। সেও আমাদের সাথে আড্ডায় যোগ দিলো। 


সকলে রাতের খাবার শেষ করে নিজেদের ঘরে চলে আসলাম। আলিফ আমার কাছে অনেক আবদার করে বললো, মুনমুন চলো না আজ দুইজনে মিলে এশার সালাত আদায় করি। 


আমিও মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। নাজাম শেষ করার পর আলিফ এক অদ্ভুত আবদার করে বসলো৷। আমার হাত ধরে বললো, মুনমুন আজ কি আমি তোমাকে নিজের করে পেতে পারি? আমি সত্যি আমার বউকে ভালোবেসে ফেলেছি। খুব ভালোবাসি তোমাকে। 


আমি খুশিতে, লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে আলিফের বুকের ভিতর মুখ লুকিয়ে বসে রইলাম৷ আলিফ আমার এমন আচরণের বুঝে গেলো আমিও ওকে নিজের করে পেতে চাই। আলিফ মুচকি হেসে বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম বলে আমাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর বিছানার নিয়ে গেলো। অন্ধকার রাত আরো একটি হালাল ও পবিত্র সম্পর্কের পূর্ণতার সাক্ষী হয়ে রইলো। 


সমাপ্ত



গল্প সম্পর্কে কিছু কথাঃ এই গল্পটি আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের সমাজে বেশির ভাগ ননদ ভাবির মধ্যে যে চিত্রপট লক্ষিত হয় তা হলো সাপে-বেজিতে। কিন্তু এই গল্পেলেখিকা ফারহানা কবির মানাল দেখিয়েছেন যে,  যেখানে শশুর- শাশুড়ীর সাথে ভালো সম্পর্ক না থাকলেও ননদ ভাবির সাথে ভালো সম্পর্ক থাকতে পারে। গল্পে লেখিকা ননদ ভাবির অকৃত্রিম ভালোবাসা সাথে স্বামীর ভালোবাসার বিষয়টি ব্যাক্ত করছেন।গল্পের কিছু অংশে লেখিকা স্বামী স্ত্রীর রোমান্টিকতাও উল্লেখ করেছেন।


শিক্ষাঃ বিয়ের পর একটা মেয়ের স্বামী, শশুর-শাশুড়ী  সন্তান, ননদ-ভাসুর-দেবর নিয়েই সংসার। তাই আমাদের উচিত প্রত্যেকেই পারস্পরিক ভালোবাসার মধ্য দিয়ে এক ভালোবাসাপূর্ন পরিবার গঠন।




বিশেষ ধন্যবাদঃ ফারহানা কবির মানাল, আমাদের এত সুন্দর একটি গল্প উপহার দেয়ার  জন্যা।




নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম