লেখিকা ফারহানা কবির মানালের সন্ধ্যাতারা গল্প। অত্যন্তু রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প।

সন্ধ্যাতারা

ফারহানা কবির মানাল





 সবেমাত্র রাতের রান্না শেষ করলাম, গোসল করার জন্য বাথরুমে যাবো। এমন সময় রহিমা কাকি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, " মা রে তোর কপাল পুড়েছে। আলভি নাকি পার্কে কোন মেয়ের সাথে খারাপ অবস্থায় ধরা পড়েছে। পুলিশ নাকি ওদের বিয়েও দিয়ে দিয়েছে। "

কাকির এসব কথা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। হতবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। হয়তো কাকি কিছু ভুল শুনেছে। আলভি কখনো এ কাজ করতে পারে না। কিন্তু আমার বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে আলভি তার সদ্য বিবাহিত বউ নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো। মেয়েটাকে দেখতে বেশ সুন্দরী। একটা সাধারণ থ্রি-পিচ পরে আছে। হঠাৎ করে বিয়ে হয়েছে বলেই হয়তো কোনো সাজগোজ করতে পারেনি। আলভি বাড়িতে আসার কয়েক মিনিট পর শাশুড়ি মা হন্তদন্ত হয়ে ও-র কাছে ছুটে আসলো।


--" আলভি এসব কি শুনছি বাবা? পুকুর ঘাটে বসে কাপড় ধুচ্ছিলাম এমন সময় আবেদা আপা এসে খবরটা দিলো। তুই কি সত্যি বিয়ে করেছিস নাকি?"


আলভি চোরের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। এতো সময় হয়তো মনের কোথাও সামান্য বিশ্বাস বেঁচে ছিলো যে আলভি বলবে এটা ওর বউ নয়। ও বিয়ে করেনি কিন্তু এখন আর কোনো আশা নেই। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হতে লাগলো। শাশুড়ি মা নতুন বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, " তোর পছন্দ তো বেশ। মাশাল্লাহ সুন্দর আছে। তা বাবা এইভাবে বিয়ে করতে গেলি কেন? আমাকে বললেই তো আমি তোর বিয়ে দিয়ে দিতাম। "


এতো সময় গ্রামের সকলের কানে খবর পৌঁছে গেছে আলভি আবার বিয়ে করছে। বাড়ির সামনে লোকের ভিড় জমছে। কেউ কেউ আমার পোড়া কপাল বলে আফসোস করছে কেউবা নতুন বউয়ের রূপের প্রশংসা করছে। কেউ আলভি কেন বিয়ে করেছে তা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি পৃথিবীতে নেই। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছি। ভয়ংকর একটা স্বপ্ন। আমার সারা শরীর অবস হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে চলে যাই কিন্তু পা নড়ছে না। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শাশুড়ি মা হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, " কি রে মুখ পুড়ি এখনো নির্লজ্জের মতো এখানে দাঁড়িয়ে আসিস কেন? আমার ছেলেটাকে তো ধরে রাখতে পারিসনি। এখন কি ছেলেটা সুখ দেখে অভিশাপ দিচ্ছিস? "


শাশুড়ি মা'য়ের কথায় কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না। সত্যি তো আমি আলভিকে ধরে রাখতে পারিনি। যদি পারতাম তাহলে হয়তো এইদিন দেখতে হতো না। আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে ঘরে চলে এলাম। আলমারি থেকে শাড়ি বের করে এলোমেলো পায়ে বাথরুম গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম। ঝর্নার শীতল পানির নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করত লাগলাম। কিন্তু মনের ভিতরের আগুন কি বাইরের পানিতে নিয়ে নেভানো সম্ভব! 


আলভির সাথে আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় চার বছর। আলভি বাবার আর আমার বাবা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সুবাদে উনার আমাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিলো। আলভিও কখনো সখনো বাবার সাথে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতো। কিন্তু বিয়ের আগে আলভির সাথে আমার কোনো প্রকার সম্পর্ক ছিলো না। আলভির বাবা মানে আমার শশুর আব্বুই আমাকে পছন্দ করে আলভির বউ করে নিয়ে আসে। কিন্তু আমার শাশুড়ি মা'য়ের কোনো কালেই আমাকে পছন্দ ছিলো না। বিয়ের এতো বছর পরেও উনি আমাকে ছেলের বউ হিসাবে মেনে নিতে পারেননি। শাশুড়ি মা চেয়েছিলো তার ভাইয়ের মেয়েকে আলভির বউ করে আনতে কিন্তু শশুর আব্বু রাজি ছিলেন না। তাই শাশুড়ি মা-ও আর কিছু করতে পারেননি। 


বিয়ের পরে জানতে পারি আলভি নাকি আমাকে বিয়ের আগে থেকেই ভালোবাসতো। সে কারণেই মাঝে মধ্যে আমাদের বাড়িতে যেতো আমাকে দেখতে। এসব কথা আমার আলভির মুখ থেকেই শোনা। বিয়ের পরে বেশ সুখেই দিন কাটছিলো আমাদের। কখনো স্বপ্নেও এমনটা ভাবতে পারিনি। বুকে প্রচন্ড ব্যাথা করছে, দম আটকে আসছে বারবার। চোখের পানিগুলো ঝর্ণার পানিতে মিলিয়ে যাচ্ছে। 


ঘন্টাখানেক গোসল করার পর কোনো রকম ভাবে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এক ঘন্টার মধ্যে বাড়ির পরিবেশ বদলে গেছে। আমার চির পরিচিত ঘরটা ফুল আর রঙিন কাগজ দিয়ে সেজে উঠেছে। সারা বাড়িতে খুশির আমেজ। বুঝতে বাকি রইলো না এটা শাশুড়ি মা'য়ের করা। কোনো কালেই তিনি আমাকে পছন্দ করতেন না। আমার জন্য শেষ বয়সে স্বামী সাথে তার তিক্ততার সম্পর্ক ছিলো। এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে শাশুড়ি মা আর শশুর আব্বু কখনো মিলেমিশে থাকতে পারেনি। রোজই তাদের ভিতর ঝামেলা হতো। আর কারণটা ছিলাম আমি। শাশুড়ি মা প্রায়ই আমাকে নানান কথা শোনাতেন, শশুর আব্বু তার প্রতিবাদ করতে গেলেই দুইজনের ঝগড়া লাগতো। আমার বিয়ের একবছরে মাথায় শশুর আব্বু মারা গেলেন। সে-ই থেকেই আমি শাশুড়ির দুই চোখের বিষ। কখনো আমাকে সহ্য করতে পারে না। একমাত্র ছেলে যদি বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যায় সেই ভয়ে আলভির সামনে তেমন কিছু বলতো না। 


নিজের চির পরিচিত ঘরটা আজ অন্যকারো জন্য সেজে উঠেছে। সব থেকে কাজের মানুষটাকে কেড়ে নিতে, ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম আলভির নতুন বউকে খুব সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে। শাশুড়ি মা নিজে হাতে সাজিয়ে দিচ্ছেন। অথচ এই মানুষটা আমাকে কখনো ভালোবাসেনি। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আলভি কোথাও নেই। বুকের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো। এখানে দাঁড়িয়ে এসব দেখা মৃত্যু যন্ত্রণার সমান তাই গুটিগুটি পায়ে হেঁটে ছাঁদে চলে এলাম। কিছুসময় আগে সূর্য ডুবে গেছে। পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছে। দিন আলো সরে গিয়ে রাতের অন্ধকার হানা দিচ্ছে পৃথিবীতে। ঠিক যেন আমার জীবনের মতো। কি থেকে কি হয়ে গেলো এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তবে আলভির জীবনে আমি আর মাত্র কয়েকদিনের অতিথি এটা খুব ভালো করে বুঝে গেলাম। আচ্ছা বউ থাকতেও কেন অন্য নারীর প্রয়োজন হয়? একজনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকা কি বড্ড কষ্টের কাজ?


চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না। চিৎকার করে কাঁদতে পারলে হয়তো কষ্ট কিছু কম হতো। ছাঁদের এক কোণে বসে আকাশ দেখতে লাগলাম। যদিও চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে তবুও আকাশ দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই ঘন কালো আকাশের সাথে নিজের জীবনের বড্ড মিল পাচ্ছি আজ। আস্তে আস্তে রাত বাড়তে থাকলো। অন্ধকার গভীর থেকে আরো গভীর হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। আল্লাহ কুরআন শরীফ বলেছেন, 

‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।’ [সুরা ইনশিরাহ : ৬]


 হঠাৎ চির পরিচিত সেই কন্ঠস্বর কানে ভেসে এলো।


--" আমাকে বাসরঘরে যাওয়ার অনুমতি দেবে না? "


এতো কষ্টের মাঝেও হাসতে ইচ্ছে করলো খুব। বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে এসেছে এখন নাটক সিনেমার মতো আমার কাছে অনুমতি চাচ্ছে। মানুষ কত অভিনয় করতে পারে! ইচ্ছে হলো আলভিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করি, কেন এমনটা করলে তুমি? এই ছিলো তোমার ভালোবাসা? ভালোই যদি না বাসতে তাহলে দিনের পর দিন কেন ভালোবাসি বলেছো?"

কিন্তু কোনো প্রশ্নই করলাম না। নিজের মতো বসে রইলাম। 


--" কি হলো আমার সাথে কথা বলবে না তুমি?"


--" নিজের নতুন বউ অপেক্ষারত রেখে প্রাক্তন বউয়ের সাথে কিসের কথা আপনার?"


--" তুমি কিন্তু আমার প্রাক্তন স্ত্রী না। তোমার সাথে আমার ভির্ভোস হয়নি। আর না তো কোনো বিচ্ছেদ!  তুমি এখনও আমার বউ।"


--" প্রাক্তন হতে গেলে বিচ্ছেদ বা ভির্ভোসের দরকার হয় না। মৃত মানুষের সাথে কিন্তু কারো সম্পর্ক থাকে না। "


--" আমি তোমার কাছে মরে গেছি?"


আলভির কথার কোনো জবাব দিলাম না। ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে বলি হ্যাঁ আপনি মৃত আমার কাছে কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। 


আলভি পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, " কি হলো বলো আমি মরে গেছি তোমার কাছে?"


আমি ও-র কথার জবাব না দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কখনো ভাবিনি আলভির বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যে মানুষটার প্রতিটা স্পর্শে ভালোবাসা খুঁজে পেতাম আর তার স্পর্শতেই যেন সমস্ত ঘৃণা লুকিয়ে আছে। 


আলভি আমাকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে বললো, " কি হলো বলো? আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই।"


আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, " আপনার কথার উত্তর দিতে আমি বাধ্য না। নিজেকে সদ্য বিয়ে করা বউয়ের কাছে গিয়ে এসব করুন। আমাকে দয়া করে ছেড়ে দিন। "


আলভি কর্কশ গলায় বললো, " তাহলে কার কথার জবাব দিতে বাধ্য তুমি?"


আমি কিছু একটা বলতে চাইলাম কিন্তু তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে আলভির হাতের উপর ঢলে পড়লাম। তারপর কি হয়েছে মনে নেই।


চোখ খুলে দেখলাম আমি ফুল দিয়ে সাজানো খাটে শুয়ে আছি। হ্যাঁ এটা আমারই ঘর যা অন্যকারো জন্য সেজে উঠেছিলো। কিন্তু আমি এখানে কেন! চারদিকে খেয়াল করে দেখলাম সকলে আমাকে নিয়ে বসে আছে। শাশুড়ি মা অগ্নি দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে ঝাঁঝালো গলায় বললেন, " আমার ছেলেটাকে কি তাবিজ পড়া খাইয়েছিস তুই? "


শাশুড়ি মা'য়ের কথায় অর্থ আমার বোধগম্য হলো না। আমার সাথে কি হয়েছে বুঝতে চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার অবাধ্য চোখজোড়া আলভিকে খুঁজে চললো। কি হবে আমার সাথে! 













আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে ঝাঁঝালো গলায় বললেন, " আমার ছেলেটাকে কি তাবিজ পড়া খাইয়েছিস তুই? "


শাশুড়ি মা'য়ের কথায় অর্থ আমার বোধগম্য হলো না। আমার সাথে কি হয়েছে বুঝতে চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার অবাধ্য চোখজোড়া আলভিকে খুঁজে চললো। কি হবে আমার সাথে! 

কিছুসময় পর আলভি একজন লোককে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। লোকটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে উনি ডাক্তার। আলভি লোকটাকে আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, " এই যে! "


ডাক্তার লোকটা আমার প্রেশার মাপতে লাগলো। ভাবতেও হাসি পায়, যে মানুষটা আমার   আত্মাটাকে মেরে ফেলেছে সে-ই আমার শরীরের চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তার ডেকে আনছে। কতটা হাস্যকর! ইতিমধ্যে আলভিকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। আলভির নতুন বউ মুখ গোমড়া  করে বসে আছে। সত্যি তো যে রাতে স্বামীকে একান্ত নিজের কাছে পাওয়ার কথা সে রাতে স্বামী অন্য কাউকে নিয়ে ব্যস্ত আছে। তাও তার প্রাক্তন স্ত্রী-কে নিয়ে। এটা কোনো মেয়েই মেনে নিতে পারবে না। অবশ্য আলভির এসব গায়ে লাগছে বলে মনে হচ্ছে না। অস্থির দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। 


--" আলভি সাহেব উনার প্রেশার বারবার উঠানামা করছে। হয়তো মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বলে এমন হচ্ছে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেছে। উনার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। আর কোনো প্রকার মানসিক চাপ দেওয়া যাবে না। আমি দুইটা ঔষধ লিখে দিচ্ছি রাতে খাইয়ে দিবেন। "


ডাক্তার সাহেব কথাগুলো বলে আলভির সাথে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আলভি চলে যেতেই শাশুড়ি মাথা চাপড়ে বলে উঠলো, " কি হয়েছে ছেলেটার আমার! এই মেয়েকে যদি এতো ভালোবাসে তাহলে কেন আর একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে? আমার ছেলেটা কি পাগল হয়ে গেলো নাকি! ও আল্লাহ গো!" 


আশেপাশে কয়েকজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলো। তাদের একজন বলে উঠলো, " তোমার ছেলেটা কি আপা? নতুন বউটাকে রেখে আগের বউকে নিয়ে পড়ে আছে। কি সব যে হচ্ছে! '


--" আমার বাড়িতে কি হচ্ছে আপনার না জানলেও চলবে। নিজের বাড়িতে গিয়ে কাজ করেন তো!"

কথাগুলো বলতে বলতে আলভি ঘরে ঢুকলো। আলভির কথায় শাশুড়ি মা আর নতুন বউ বাদে সকলে ঘর থেকল বের হয়ে গেলো। যাওয়ার আগে একজন বললো, " এতো ঢং তো নাটক সিনেমায় ও থাকে না। "


শাশুড়ি মা আলভিকে জিজ্ঞেস করলেন, " এসব কি করছিস তুই?"


আলভি মায়ের কথার জবাব না দিয়ে আমাকে উদ্দ্যেশ্যে করে বললো, " ডাক্তারের কথাগুলো জানি মনে থাকে।! "


আমি ও-র কথায় কোনো জবাব দিলাম না। শুধু এক দৃষ্টিতে ও-র নতুন বউকে দেখতে লাগলাম। মেয়েটা এতো শান্ত হয়ে আছে কি করে!  আলভি ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে আসা পর্যন্ত আমি খাটে বসে রইলাম। শাশুড়ি মা আফসোস করছেন তার ছেলের কি হয়েছে, মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে। বাকিরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আলভি বাড়িতে ফিরে আসার পর শাশুড়ি মাকে বললো, " মা তুমি নীলিমার থাকার জন্য গেস্ট রুমটা খুলে দেও। "


শাশুড়িসহ সকলেই হা করে আলভির দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই সাথে আমিও হতবাক হয়ে ও-র দিকে তাকিয়ে রইলাম।  


শাশুড়ি মা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, " এসব কি আলভি নতুন বউ গেস্ট রুমে কেন থাকবে? আর তোমার ঘরে কে থাকবে?"


আলভি শান্ত গলায় বললো, " এতোদিন যে থাকতো আজও সে থাকবে। আমি অনেক বেশি ক্লান্ত মা প্লিজ তোমরা যাও। " 


শাশুড়ি মা গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। মেয়েটাও পুতুলের মতো শাশুড়ি মা'য়ের সাথে চলে গেলো। কিসব যে হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না আমি। নীলিমা যদি আলভির বিয়ে করা বউ হয় তাহলে এসব কি! মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সকলে চলে যেতে আলভি দরজা বন্ধ করে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লো। আলভিকে আজ কেমন রহস্য লাগছে আমার কাছে। 


--" নতুন বউ থাকতে আপনি আমার কাছে ঘুমাচ্ছেন কেন?"


আলভি শার্ট খুলতে খুলতে বললো, " আগের বউ বাসরঘরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি তাই।"


আলভি এমন কথায় আমার খুব রাগ হচ্ছে। আমার সাথে এমন করে কি মজা পাচ্ছে কে জানে। এদিকে আমি শোকে পাথর হয়ে যাচ্ছি, অন্যদিকে সে হেঁয়ালি করছে। 


--" মানে? কিসব বলছেন আপনি? একটু পরিষ্কার করে বলেন তো।"


আলভি আলমারি থেকে একটা গেঞ্জি বের করে পরে নিলো তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, " একটা মানুষ জীবনে কতবার বিয়ে করে তানিয়া?"


--" যতো বার একটা মানুষের ইচ্ছে করে!"


আলভি আর কিছু না বলে শুয়ে পড়লো। আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না৷ হয়তো আমার সাথে কথা বলতে চায় না। বিছানা থেকে উঠতে যাবো এমন সময় আলভি আমার হাত টেনে ধরলো। এবার আর সহ্য হচ্ছে না। আলভির উদ্ভট ব্যবহার আমি আর নিতে পারছি না। আলভি কি বুঝতে পারছে না ও-র দ্বিতীয় বিয়ে আমাকে ঠিক কতটা কষ্ট দিচ্ছে! নাকি জেনে বুঝে আমার সাথে মজা করছে। হয়তো আমাকে কষ্ট পেতে দেখে ও-র আনন্দ হচ্ছে। 


আমি আলভির হাত ছাড়াতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু পারলাম না। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম, " কি হয়েছে হাত ধরেছেন কেন?"


--" কোথায় যাচ্ছো তুমি?"


--" আমি যেখানেই যাই না কেন তাতে আপনার কি একটু বলেন তো।"


--" অন্যকারো?"


--" অন্যকারো মানে?"


--" কিছু না। এখন কোথাও যাওয়া যাবে না। চুপচাপ শুয়ে পড়ো। ডাক্তার বলেছে তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। "


আমি ও-র কথায় তেমন হেলদোল দেখালাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আলভি খাট থেকে উঠে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলো  তারপর বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলো। 


--" কোথাও যাওয়া যাবে না বলছি তো। "


আমি আর সহ্য করতে পারলাম না৷ আলভিকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলাম। সত্যি এসব আমার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আলভি এই ব্যবহার আমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিচ্ছে। আমাকে নিয়ে যদি ও এতটাই ভাবে তাহলে কি করে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারলো?


আলভি অবশ্য আমাকে কিছু বললো না। একহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো আর অন্য হাত দিয়ে কপালে, চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছি ঠিক মনে করতে পারলাম না  সকালে ঘুম থেকে উঠে সারা শরীরে অনেক ব্যাথা অনুভব করলাম। মাথাটাও বড্ড জ্বালা করছে। আলভিকে আসেপাশে কোথাও দেখতে পেলাম না। কোথায় গেছে কে জানে! 


নিজের কপালে হাত দিতেই বুঝতে পারলাম আমার সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এই জন্য সারা শরীরে এতো ব্যাথা। কাল বিকালে অতো সময় গোসল করার জন্যই হয়তো জ্বর এসেছে। 

কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হলাম। আমাকে দেখে শাশুড়ী মা বলে উঠলো, " এই কালনাগিনী মেয়েটা আমার ছেলেটার মাথাটা মুড়িয়ে খেয়েছে। ছেলেটাকে একটু সুখে দেখতে পারে না৷ কি তাবিজ করছে কে জানে। এতো সুন্দর একটা নতুন বউ থাকতে শেষে কিনা সারারাত এর সাথে কাটালো। আল্লাহ গো! এ আমার কি হলো গো!"


নীলিমা পাশেই একটা চেয়ারে বসে ছিলো। শাশুড়ি মা'য়ের কথা শুনে বলে উঠলো, " আপনি মনে হয় অনেক সিরিয়াল দেখেন তাই না? আপনার ব্যবহার একদম সিরিয়ালের শাশুড়িদের মতো লাগছে৷ "


নীলিমার কথা শুনে শাশুড়ি মা নিজের কপাল চাপড়ে বললেন, " আমার ছেলে এ কাকে বিয়ে করে এনেছে! আল্লাহ গো! যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। আলভি বাবা তোর কপালটা অনেক খারাপ রে! এইসব মেয়ে তোর কপালে জুটলো। আমার ভাইয়ের মেয়েটা কত ভালো ছিলো। শুধু তোর বাপের জন্য অতো মেয়েটাকে ছেলের বউ করতে পারলাম না। লোকটা নিজের ছেলের ভালোও বুঝতে পারলো না।"


শাশুড়ি মা এবার সত্যি সিরিয়ালের শাশুড়িদের মতো ভাব করছে। নীলিমা অবশ্য শাশুড়ি মাকে কিছু বললো না৷ ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইলো। আমিও সেখানে সময় নষ্ট না করে সারা বাড়িতে আলভিকে খুঁজতে লাগলাম। এ বাড়িতে আলভির সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হলো ও-র  ফুলের বাগান৷ নিজের হাতে নানান রকমের গাছ লাগায়। পরিচর্যা করে। ফুলের বাগানের পাশে একটা দোলনাও লাগিয়েছে ও। তার নাকি এমন বাগান খুব ভালো লাগে। কত রাত আলভির সাথে দোলনায় বসে গল্প করেছি ঠিক নেই। কখনো কখনো গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যেতাম দু'জন  সকালে নিজেদের দোলনায় দেখে খুব হাসতাম। পুরোনো স্মৃতি মনে পড়তেই চোখে পাতা ভিজে গেলো। আগে কি সুন্দর ছিলো সবকিছু আর এখন সবকিছু যেন ধোঁয়াসা। কিসব হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। বাগানে গিয়ে দেখলাম আলভি সেখানে নেই। আশাহত হয়ে বাগান থেকে ফিরে আসার সময় দেখলাম আলভি সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকছে। এতো সকালে কোথায় গিয়েছিল? আলভিকে অনুসরণ করে ঘরের ভেতর গেলাম। 


ঘরের দরজা থেকে আলভি নীলিমার নাম ধরে ডাকতে লাগলো। নীলিমা আলভির গলা পেয়ে রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো। তারপর আবার দুইজন মিলে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। 

কাল হয়তো আলভি আর নীলিমা মিলে আমার সাথে মজা করছে। নাহ্ অনেক হয়েছে আজ আমি এ বাড়ি থেকে চলে যাবো। আলভির এ নাটক আমি আর নিতে পারছি না। চোখ মুছে ছাঁদের দিকে হাঁটা ধরলাম। 















আলভির এ নাটক আমি আর নিতে পারছি না। চোখ মুছে ছাঁদের দিকে হাঁটা ধরলাম। গতকাল কয়েকটা শাড়ি আর বোরকা হিজাব ধুয়ে ছাঁদে শুকাতে দিয়েছিলাম। সেখান থেকে বোরকা হিজাব পরে চিরতরে এ বাড়ি থেকে চলে যাবো। আলভির দুই রকম ব্যবহার আমি নিতে পারছি না। একটা কষ্ট হয়তো বুকে চেপে বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু দুই রকমের ব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না। কখনো মনে হয় আলভি আমারই আছে, কাউকে বিয়ে করেনি ও, কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। কখনো বা মনে হয় নীলিমা আলভিকে জয় করে নিয়েছে। আলভির নতুন বিয়ের বয়স এখনো একদিন পার হয়নি। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে কয়েক যুগ ধরে আমি এই কষ্ট সহ্য করছি। 


এই ছাঁদের প্রতিটি জায়গায় আমার আর আলভির স্পর্শ লেগে আছে। কত রাত দুইজন মিলে তারা গুনেছি, চাঁদ দেখেছি। জীবনে ভালোবাসার অভাব ছিলো না। 

' প্রিয় ভালোবাসা দিন শেষে তুইও আমার সন্ধ্যাতারা হয়ে গেলি'

নীল আকাশ যখন কালচে লাল হয়ে যায় তখন তোর দেখা মেলে, তারপর নীল আলোয় আলোকিত আকাশ কালো বর্ণ ধারণ করে,  আস্তে আস্তে সেই অন্ধকারে যেন ঢেকে ফেলে সম্পূর্ণ আকাশকে। নিকষ কালো আকাশে আশার প্রদীপ হয়ে ফুটে ওঠে হাজার তারা। ঠিক যেন আমার জীবনের মতো। আলভির কেয়ার গুলো যেন আমার কাছে আশার প্রদীপ! 


সকালের দিকে হয়তো বৃষ্টি হয়েছে। বোরকা হিজাব ভিজে গেছে। ভেজা বোরকা হিজাবই পরে নিলাম। কি আর হবে আমার! মরে যেতে পারলেই তো সব থেকে ভালো হয়। আসলেই কি তাই! মরার পর কি জবাব দিবো আল্লাহর কাছে, কবরের আযাব মাফ হবে তো?


কাজ শেষ করে নিচে নামতেই দেখলাম আলভি আর নীলিমা ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। ওদের সামনে পড়তে ইচ্ছে করলো না, তাই চুপচাপ সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে রইলাম। আলভি শাশুড়ি মা'য়ের কাছে জিজ্ঞেস করলো, " মা তানিয়া কোথায় গেছে?"


-' আমি কি জানি তোর নবাবজাদি বউ কোথায় কি করে বেড়াচ্ছে!  আমাকে ও-র বডিগার্ড রেখেছিস নাকি? কি ছেলে জন্ম দিলাম আল্লাহ!"


--" মা আপনি বড্ড সিরিয়াল দেখেন, এসব না করে একটু কুরআন হাদিস তো পড়তে পারেন নাকি?"


নীলিমা মুখে মা ডাক শুনে আমার আত্মা কেঁপে উঠলো। তাহলে সত্যি নীলিমা আলভির বউ? না হলে কেন শাশুড়ি মাকে মা বলে ডাকবে? আলভি নীলিমার কথায় মুখ চেপে হাসছে। শাশুড়ি মা মুখ বেঁকিয়ে ঘরে চলে গেলেন। অবাধ্য আঁখি থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বেইমানগুলোকেই কেন আমরা এতো ভালোবাসি!


--" ভেজা বোরকা পড়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?"


আলভির গলা শুনে চমকে উঠলাম। ভালো করে আসে পাশে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও সে নেই। হয়তো আমার কান ভুল শুনেছে,  মস্তিষ্ক আমাকে ভুল সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। আর এক মুহুর্ত দেরী না করে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এই দরজাটা পেরিয়ে গেলে হয়তো জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবো। কিন্তু আসলেই কি তাই দুনিয়ার কোনো কষ্টই জাহান্নামের আযাবের সমান হতে পারে না। জাহান্নাম যে চিরশাস্তির স্থান। 


দরজা পার হতে গেলেই আলভি আমার হাত টেনে ধরলো। তারপর রাগী গলায় বললো, " কোথায় যাচ্ছো তুমি? তোমার শরীর এতো গরম। অসুস্থ অবস্থায় কোথাও যেতে পারবে না তুমি। ঘরে আসো। "


কথাগুলো বলে আমার হাত ধরে টানতে লাগলো। অনেক সহ্য করেছি, আমার পক্ষে আর

এসব সহ্য করা সম্ভব নয়। এক ঝটকায় আলভির হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। আলভি একপলক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও আমার হাত ধরতে গেলো। আমি আলভির গালে একটা থাপ্পড় দিলাম। আলভি হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। 


আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, " কি নাটক শুরু করেছেন আমার সাথে? এমন লুকোচুরি খেলে কি সুখ পাচ্ছেন আপনি? দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ ঘরে এনে প্রথম বউয়ের সাথে এতো নাটক না করলেও পারতেন আপনি। আমার প্রতি এতো দরদ দেখিয়ে কি প্রমাণ করতে চান?  আপনি ভালোবাসেন আমাকে? আসলেই? আপনি যদি আমাকে ভালোই বাসবেন তাহলে কেন আমাকে ঠকালেন? কি হলো চুপ করে আছেন কেন?"


আলভি খুব শান্ত গলায় বললো, " আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবো। দয়া করে তুমি এই ভেজা কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না। তোমার শরীর অনেক খারাপ হবে। "


আমি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম, " বেইমান, বিশ্বাসঘাতক লোকেদের মুখে এসব কথায় মানায় না। আপনার এই আলগা দরদ আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন প্লিজ।"


--" তুমি আমাকে একটু তো সময় দেও কিছু বলার। আমি সব বলবো তো তোমাকে। "


--" কি বলবেন আপনি? নিজের প্রেম কাহিনী শোনাবেন আমাকে? কি করে দ্বিতীয় বিয়ে করলেন ব্যাখ্যা করবেন? আমি আপনার মুখটাও দেখতে চাই না। বিয়ে করেছেন নতুন বউ নিয়ে সুখে থাকেন। আমাকে নিয়ে এমন লুকোচুরি করবেন না। "


আলভি আমার কথার কোনো জবাব দিলো না। চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলো। আমি কি একটু বেশি বলে ফেললাম ও-কে? তেষ্টায় গলা বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। শরীর মনে হয় জলন্ত উনুনে পরিনত হয়েছে। ভিজা বোরকা পরে থাকার জন্য হয়তো জ্বর কিছুটা বেড়ে গেছে। দৌড়ে  গিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। তবুও তেষ্টা মিটছে না। আরো এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। শরীরটা হঠাৎ অনেক খারাপ লাগছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। এক পা-ও চলার শক্তি নেই। মাথা ঘুরে পড়ে যাবো হয়তো। কোনো রকম ঘরে গিয়ে বোরকা খুলে শুয়ে পড়লাম। শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। আচ্ছা আমার কি বড় কোনো রোগ হয়েছে! এমন কিছু যাতে আমি তাড়াতাড়ি মরে যাবো। এই মিথ্যা দুনিয়ার মায়া থেকে মুক্তি পাব। জ্বর ক্রমশ বাড়তে লাগলো। বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বিছানার পাশে একটা বোতলে পানি রাখা থাকে, সেখান থেকে বারবার পানি খেতে লাগলাম। কিছুতেই তেষ্টা মিটছে না। মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। কখন যে অজ্ঞান হয়ে গেলাম নিজেও জানি না। 

চোখ খুলে দেখলাম নীলিমা আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। মেয়েটা কোন ধাতু দিয়ে তৈরি কে জানে! নিজের সতীনের সেবা করছে। আমি চাইলেও কেন নীলিমাকে ভালো মনে করতে পারলাম না জানি না। হয়তো আমার জিনিসে ভাগ বসিয়েছে তার জন্য।  কোনো মেয়েই তার স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে চায় না। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। 


আমি চোখ মেলেছি দেখে নীলিমা বললো," আপনার এখন কেমন লাগছে? আপনি তো জ্বরের কারণে অজ্ঞান হয়ে গেছেন দেখে আমি মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিলাম। "


--" আপনার এতো কষ্ট করার কি দরকার ছিলো? আমি মরে গেলেই ভালো হয় "


--" হায়াত থাকতে তো আপনি মরবেন না। শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কি আছে?"


নীলিমা কথাগুলো আমার কেন জানি ভালো লাগছে না। আসলে মন থেকে ভালো না লাগে যাকে অপছন্দ তার কোনো কিছুই ভালো লাগে না। নীলিমার ব্যাপারটাও ঠিক তেমন। আমার সব থেকে বড় জিনিস আমার থেকে কেড়ে নিয়ে এখন এসব দরদ দেখিয়ে কি লাভ! ইচ্ছে করছিলো ও-কে অনেক কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু চুপ করে রইলাম। 


শাশুড়ি মা হয়তো নীলিমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। নীলিমার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে আমার ঘরে আসলেন। নীলিমাকে আমার কপালে জলপট্টি দিতে দেখে বললেন, " দুই সতিনের এমন মিল তো সিরিয়ালেও দেখা যায় না। "


নীলিমা মুচকি হেসে বললো, " আপনি মনে হয় সারাক্ষণ সিরিয়াল নিয়ে বসে থাকেন। একটা মানুষ অসুস্থ কষ্ট পাচ্ছে, তার সেবা না করে আমি চুপচাপ বসে থাকবো এতোটা ব্যক্তিত্বহীন আমি না। আপনি তো উনার শাশুড়ি,  মায়ের মতো, এসব করার দায়িত্ব তো আপনার তাই না?"


শাশুড়ি মা কিছু না বলে মুখ বেঁকিয়ে চলে গেলো। আমি নীলিমাকে প্রশ্ন করলাম, " আচ্ছা নীলিমা, তোমার সাথে আলভির কি করে বিয়ে হয়েছে? "


নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, " দুইজন বিবাহিত মানুষকে ধরে একটা কাগজে সই করে দিলেই কি বিয়ে হয়ে যায় বলো?"


নীলিমার কথায় আমি বেশ অবাক হলাম। হতবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, " দুইজন বিবাহিত মানুষ মানে কি?"


--" আমিও বিবাহিত তানিয়া। আলভির যেমন আপনি আছেন আমার তেমন স্বামী আছে। আলভির সাথে আমার গতকালই দেখা হয়েছে।"


--" কিসব বলছো তুমি নীলিমা? আলভির সাথে তোমার কেনো সম্পর্ক নেই?"


--" নাহ্, আলভির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি আমি উনাকে চিনতামও না। "


--" কিসব বলছো তুমি নীলিমা?  আমাকে সবকিছু খুলে বলো প্লিজ।"


নীলিমা কিছু বলতে যাবে এর আগে আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। ফোনের স্কিনে আলভির নম্বরটা জ্বলজ্বল করছে। দেরী না করে কল রিসিভ করলাম। 


--" তানিয়া,'


--" হ্যাঁ বলো, "


--" এতো বছরের বিবাহিত জীবনে আমি একটা মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি। আজ নিজের কাছেই আমি হেরে গেছি। আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে বেইমান বলেছে, সে আমার মুখও দেখতে চায় না। তাহলে আমি আর আমার মুখ তোমাকে দেখাবো না। একটা শেষ অনুরোধ তোমার কাছে আমার মা'কে একটু দেখে রেখো প্লিজ। ভালো থেকো, নিজের খেয়াল রেখো।"


আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আলভি কল কেটে দিলো। আমি আবার কল দিলাম কিন্তু ফোন বন্ধ। আল্লাহ এ কোন পরীক্ষায় ফেললেন আমাকে! চোখ বন্ধ করে আল্লাহ কাছে সাহায্য চাইতে লাগলাম। চোখের সামনে কুরআনের একটি আয়াত ভেসে উঠলো। 


--" জেনে রেখো, আল্লাহর সাহায্যে অতি নিকটে! ( সূরা আল-বাকারা, আয়াত ঃ ২১৪) 











আমি নীলিমার হাত চেপে ধরে বললাম, " নীলিমা কি হয়েছে আমাকে দয়া করে সবটা খুলে বলো। এই গোলকধাঁধা আমি আর নিতে পারছি না। 


নীলিমা ও-র চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছে বললো, " জানো তো তানিয়া, জীবন কখনো কখনো সিনেমাকেও হার মানায়! আমার বাড়ি বাগেরহাট জেলার একটা ছোট্ট গ্রামে। জন্মের সময় মা মারা গেছে,  বাবাও অন্য একজনকে বিয়ে করে আবার ঘর বেঁধেছে। কিন্তু তাদের সংসারে কাঁটা হয়ে গেছি আমি। আমার সৎ মা যে আমাকে খুব একটা খারাপ জানতো এমনটা না। কিন্তু আশেপাশের লোকজন বারবার মনে করিয়ে দিতো আমার মা নেই, আমি যাকে মা বলে ডাকি সে আমার নিজের মা নয়। মায়ের কাছেও বলতো সৎ মেয়ে বলে ও-কে তুমি কষ্ট দিও না। মা প্রথম প্রথম এসব মেনে নিলেও পরে আব্বুকে বলে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। আমি থাকলে তাকে রোজ নানান লোকের নানান কথা শুনতে হয়। কথাটা মা একটুও মিথ্যা বলেনি জানো। আমি নিজেও অনেকবার অনেক লোককে মা'কে বিনা কারণে কথা শোনাতে দেখেছি। একদিনের একটা ঘটনা বলি, আমি সারাদিন না খেয়ে স্কুলে ছিলাম। পরে খেলতে গিয়ে সন্ধ্যার পরে বাড়ি এসেছি বলে মা আমাকে মেরেছে, সকাল বেলা তিন-চারজন মহিলা মা'কে বলছে, সৎ মেয়ে বলে মেয়েটাকে মারতে পারলে! এ ভাবেই আমাদের দিন কাটতে থাকে। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো পড়াশোনা করে একটা চাকরি করবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো। মা বাবা আমাকে কখনো বাঁধা দেয়নি। সৎ মা হওয়ার পরও আমার মা কখনো আমার বাবাকে আমার পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু গ্রামের দিকে মেয়েরা স্কুলের গন্ডি পেরোলেই বিয়ে বয়স হয়ে যায়। সেখানে আমি অনার্স পড়ি। নানান লোকের নানান রকমের কথা। বাবাকে তেমন কিছু বলতে না পারলেও মা'কে রোজই সকলে কথা শোনাতো। সৎ মেয়ে বলে মা নাকি আমাকে ঘরের খুঁটি করে রাখতে চায়। এমন অনেক কথা। লোকের এতো কথা মা আর সহ্য করতে পারেনি। তাই বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। আল্লাহর রহমতে আমার স্বামী আমাকে খুব ভালোবাসে। বেশ কয়েক মাস আগে আমার স্বামী কাজের খোঁজে ঢাকায় আসে। মোবাইলে আমাদের রোজ কথা হতো। কয়েকদিন আগে সে আমাকে ঢাকায় আসতে বলে, এখন থেকে আমরা দুইজন নাকি ঢাকাতেই থাকবো। কথা ছিলো আমি বাগেরহাট দিয়ে বাসে উঠবো আর সে আমাকে এসে নিয়ে যাবে। বাগেরহাট থেকে আব্বু আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বাস থেকে নামার পর তাকে আর খুঁজে পাইনি। সে বলেছিলো আমাকে বাসস্ট্যান্ডে নিতে আসবে কিন্তু কেন আসেনি জানি না। এমনকি তার মোবাইলটাও বন্ধ। ঢাকার শহর আমি কিছুই চিনি না। কোথায় কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। 


--" তাহলে আলভির সাথে তোমার পরিচয় হলো কি করে? আর তোমাদের বিয়েই বা হলো কি করে?"


নীলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো," আমি বারবার আমার স্বামীকে কল দিচ্ছিলাম কিন্তু প্রতিবার ফোন বন্ধ বলছিলো। কি করবো বুঝতে না পেরে বাসস্ট্যান্ডের পাশেই একটা পার্কে বসে কাঁদছিলাম। তখন আলভি সাহেব আমার কাছে আসে। তারপর আমার সাথে কি হয়েছে সবকিছু জানতে চায়। আমিও তাকে সব খুলে বলি। তখন আলভি আমাকে বলে সে আমার স্বামীকে খুঁজতে আমাকে সাহায্য করবে। "


--" এ পর্যন্ত তো স্বাভাবিক ব্যাপার। একটা মানুষ কাঁদলে তার কাছে কারণ জানতে চাওয়া বা তাকে সাহায্য করবে বলে আস্বস্ত করা দোষের তো কিছু না৷ তারপর কি হলো?


নীলিমা খাটের পাশে টেবিলের উপরে রাখা পানির বোতল থেকে একটু পানি খেয়ে নিলো তারপর বললো,


আসলে সেদিন, 


আলভি নীলিমার সব কথা শোনার পর নীলিমাকে বললো, " আপনি এইভাবে কাঁদবেন না। আমি আপনার স্বামীকে খুঁজতে সাহায্য করবো। আপনি তো মনে হয় সে-ই সকালবেলা বেরিয়েছেন। রাস্তায় কি কিছু খেয়েছেন?"


নীলিমা মাথা নেড়ে না বললো। নীলিমা কিছু খায়নি দেখে আলভি পাশের একটা দোকান থেকে সামান্য খারাপ কিনে নীলিমাকে দিয়ে বললো, " আপনি এগুলো খেয়ে নেন। "


নীলিমার  চোখে কৃতজ্ঞতার ছাপ ফুটে উঠলো। আস্তে আস্তে খাবারগুলে শেষ করে আলভির দিকে তাকিয়ে বললো, " একটু পানি এনে দিবেন? "


 নীলিমা মেয়েটা যেন বাচ্চাদের মতো আবদার করছে। আলভি দেকান থেকে একটা পানি কিনে নিয়ে এলো। পানির বোতলটা নীলিমার হাতে দিতেই কয়েকজন পুলিশ নীলিমা আর আলভির কাছে আসলো। 


--" কি রে পার্কে বসে প্রেম করিস নাকি?"


আলভি উনাদের সবকিছু খুলে বললো। কিন্তু উনারা আলভির কোনো কথা বিশ্বাস না করে বললো, ' বহুকাল ধরে এসব কাহিনী শুনে আসছি। এসব সিনেমার কাহিনী এখানে বলে কোনো লাভ নেই।'


আলভি উনাদের বললো, " স্যার আমি মিথ্যা বলছি না। তাছাড়া একসাথে কোনো ছেলেমেয়ে থাকলেই তারা প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে যায় না৷ বা তাদের ভিতর কোনো অবৈধ সম্পর্ক থাকে না। '


--' আমরা তোর কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না। চল তোদের আজ বিয়ে দিয়ে দিবো। এভাবে রাস্তাঘাটে পরিবেশ নষ্ট করা যাবে না। '


বিয়ের কথা শুনে  আলভি চমকে উঠলো। হাতজোড় করে বললো, " স্যার বিশ্বাস করেন আমি বিবাহিত। এই মেয়ের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনারা এসব করতে পারেন না। এদেশের নাগরিক হিসাবে আমার স্বাধীন ভাবে চলার অধিকার আছে। '


--" আমরা কি পারি আমরা বুঝবো! তোদের ভিতর যদি কোনো প্রকার সম্পর্ক না থাকে তাহলে তোদের গার্জিয়ানদের কল দে। "


আলভি মোবাইল বের করে কাদের জানি কল দিছিলো অনেকবার  কিন্তু কেউ কল ধরেনি। আর আমার মানুষটার ফোন তো বন্ধ। আব্বুর সাথে পুলিশের সামান্য কথা হলেও ওঁরা কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি। এজন্য আলভি অনেক রেগে যায়। কিন্তু রেগে যাওয়ার কারণে ফল আরো খারাপ হয়। পুলিশের লোকরা আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সই করিয়ে তারপর ছাড়ে। কাজী অফিসে কে জানি আলভিকে দেখে ফেলে আর নিমেষেই আলভি বিয়ে করেছে এ কথা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কাল আসার পথে আলভি কার সাথে সারাপথ কথা বলতে বলতে এসেছিলো। তুমিই তো ছিলে মনে হয়। তোমার নাম ধরে ডেকেছিলো অনেকবার । তারপর তো তোমাদের বাড়িতে চলে আসলাম। এরপর থেকে তো তুমি সব জানো। এখন বলো এইভাবে দুইজন মানুষের বিয়ে দিলে কি কখনো কারো বিয়ে হয়? বিয়ে জিনিসটা কি এতোটাই সহজ? তাছাড়া আমি আমার স্বামীকে অনেক বেশি ভালোবাসি। সে ছাড়া অন্য কারো কথা আমি চিন্তাও করতে চাই না। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো, তোমার স্বামী তোমারই আছে। আমি আমার বরকে খুঁজে পেলেই তার কাছে চলে যাবো।'


নীলিমার কথা শুনে আমার মোবাইলটা চেক করতে লাগলাম। কাল আলভি আমাকে কল দিয়েছিলো কিনা দেখার জন্য।  মিসকল চেক করতে গিয়ে দেখলাম আলভির ১৭৫টা মিসকল। সাথে কিছু এমএমএসও আছে। এসএমএসগুলোতে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ন কথা নেই কিন্তু বেশ কয়েকবার বলেছে যে ম্যাসেন্জার চেক করো। 

ডাটা অন করে ম্যাসেন্জার চেক করতে লাগলাম। আলভি অনেকগুলো ভয়েস রেকর্ড দিয়েছে। শেষে একটা এসএমএসও দিয়েছিলো, 


" তানিয়া আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। আমার জীবনে অন্যকারো প্রয়োজনীয়তা নেই"


হ্যাঁ তাই তো। গতকাল গোসলে যাওয়ার আগে ম্যাসেন্জার চেক করেছিলাম, আলভি কিছু বলেছে কিনা দেখার জন্য। তখন আলভির এই এসএমএসটা আমি দেখেছিলাম, আলভির ভয়েস রেকর্ড আর এসএমএসের কথাটা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগছিলো কারণ আলভি বাইরে গেলে ভয়েস এসএমএস দেয়। কিন্তু ভয়েস এসএমএসগুলো শুনতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যেতো গোসল করতে তাই মোবাইল রেখে গোসলে যাচ্ছিলাম আর তখনই কাকি আমাকে আলভির দ্বিতীয় বিয়ের খবর দেয়। কি বলেছিলো আলভি?


ভয়েসগুলো এক এক করে শুনতে লাগলাম। এতো সময় নীলিমা আমাকে যেসব বললো আলভিও ঠিক তাই বলেছে। তার মানে আলভি মনে করেছে আমি নীলিমা আর ও-র বিয়ের ব্যাপারে সবটা জানি। কারণ সব এসএমএস সিন করা। কিন্তু এদিকে আমি কিছুই জানতাম না। ওরে আল্লাহ এ কোন বিপদে পড়লাম আমি! সে-ই জন্যই আলভি কাল বাড়ি ফিরে আমাকে কিছুই বলেনি। কারণ ও জানতো আমি সব জানি। 

(নোটঃ অনেকে বলবেন যে পুলিশ এইভাবে বিয়ে দেয় না। কিন্তু আমাদের এখানে এক পার্কে একদিন পুলিশেরা ছেলেমেয়েদের একসাথে পেয়ে ৩২ জোড়া বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো। তাদের ভিতর আমার এক পরিচিত মেয়ে ছিলো যে বিনা কারণে ফেঁসে গেছিলো এবং তারও বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো অপরিচিত একটা ছেলের সাথে)


 স্বভাবত আলভি অনেক জেদি একটা ছেলে। রাগ অভিমান সব কিছু অনেক বেশি। সামান্য কিছু হলেই মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। আর এখন তো অনেক বড় ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমার উপর রাগ করে আলভি নিজের কোনো ক্ষতি করে ফেলবে না তো? আল্লাহ ও জানি কিছু করে না বসে। এ কোন পরীক্ষায় পড়লাম আমি! দেরী না করে আলভির নম্বরে কল দিলাম। ওপাশ থেকে কোকিলকণ্ঠী এক মেয়ে জানান দিলো, 'আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।  কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। '


এখন আলভিকে আমি কোথায় খুঁজে পাবো? সবকিছু না জেনে আলভিকে এইভাবে অবিশ্বাস করা আমার উচিত হয়নি। আসলে সমাজে এখন পরকীয়া এতোটা বেড়ে গেছে যে আমরা অন্যকিছু ভাবতেই পারি না। কোনো ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখলেই মনে করি তাদের ভিতর প্রেমের সম্পর্ক। 

আলভির নম্বরে বারবার কল দিতে লাগলাম। প্রতিবারই মোবাইল বন্ধ। এই ছেলেকে এখন কোথায় খুঁজে পাবো আমি? নিমেষেই চোখের পাতা ভিজে গেলো। এতো সময় এক কষ্টে কষ্ট পাচ্ছিলাম, এখন অন্য চিন্তায় মরে যাচ্ছি।  কি করবো এখন?












দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো আলভির কোনো খোঁজ নেই। যতবার ও-কে কল দিয়ছি ততোবারই এক পরিচিত গলা জবাব দেয়, " আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরের সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না! " কোথায় যেতে পারে আলভি কিছু বুঝতে পারছি না। ও-র সকল বন্ধু,  অফিসের কলিগ আত্মীয় স্বজন সবার কাছে ও-র খোঁজ নিয়েছি কিন্তু কেউ-ই বলতে পারছে না আলভি কোথায় গেছে। এদিকে আমার শরীরও আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রচন্ড জ্বর সে-ই সাথে এতো টেনশন, সবকিছু মিলিয়ে খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। নীলিমা সর্বক্ষণ আমার সাথে আছে। আমাকে নানান কথা বলছে, এসব দেখে আমার শাশুড়ি মা ভিষণ বিরক্ত!  নিজের মতো কিসব বকবক করছে আবার চুপ করে টিভি দেখছে। দুপুরের দিকে নীলিমা সামান্য পরিমাণ ভাত লেবু দিয়ে চটকে জোর করে আমাকে খাইয়ে দিয়েছে। খাওয়ার পর একটা প্যারাসিটামল ঔষধও খেতে দিয়েছিলো। ওষুধের প্রভাবে শরীর সময়ের সাথে কিছুটা ঠান্ডা হচ্ছে কিন্তু মনের মাঝে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। 


বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো এখনও আলভির কোনো খবর নেই। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার শরীর এখন মোটামুটি, জ্বর নেই কিন্তু প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে। সন্ধ্যার দিকে শাশুড়ি মা আমার কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, " তানিয়া আলভি কোথায় গেছে বলতে পারো? ছেলেটা সেই সকালে বের হয়ে চলে গেলো এখনও আসার নাম গন্ধ নেই। "


শাশুড়ি মা'য়ের কথার কও জবাব দিবো বুঝতে পারলাম না। শুধু চোখ মুছে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। শাশুড়ি মা আমার দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থাকলেন তারপর ইশারায় তার ঘরে যেতে বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আল্লাহ জানে এখন কি বলবেন সে!


গুটিগুটি পায়ে হেঁটে শাশুড়ির ঘরে গেলাম। শাশুড়ি মা আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, " এখানে বসো। কিছু কথা বলি। "


আমার ভিতরের অস্থিরতা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। শাশুড়ি মা যদি জানতে পারেন আমার কথায় কষ্ট পেয়ে আলভি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে তাহলে আমাকে খুন করতেও তার হাত কাঁপবে না। চুপচাপ গিয়ে খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসে পড়লাম। 


শাশুড়ি মা শান্ত গলায় বললো, " মা আমাকে তুমি মাফ করে দিও। সকালে আলভির ব্যবহার দেখে আমার মনে হয়েছে আলভি তোমার সাথেই সব থেকে বেশি খুশি। অন্য কাউকে পেলে হয়তো ছেলেটা এতো খুশি থাকতো না। "


আমি অবাক দৃষ্টিতে শাশুড়ি মা'য়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শাশুড়ি মা হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি তার কথা বুঝতে পারিনি। তাই আবারও বলে উঠলো, " সকালে আমি আলভি আর নীলিমাকে নিয়ে এক জায়গাতে বসে কথা বলেছিলাম। তুমি হয়তো জানো না। কারণ আমি আলভিকে বলেছিলাম দরজা আটকে দিতে। "


শাশুড়ি মা'য়ের কথা শোনার পর আমার চোখের সামনে সকালের দৃশ্য ভেসে উঠলো। আলভি নীলিমাকে ডাকতে ডাকতে বাড়িতে ঢুকছে। নীলিমা আলভির ডাক শুনে ঘর থেকে বের হয়ে এলো তারপর আবার আলভির সাথে ঘরে চলে গেলো। তারপর আলভি দরজা আটকে দিয়েছিলো। আমি মনে করে ছিলাম আলভি আর নীলিমা একান্ত সময় কাটানোর জন্য এক ঘরে আটকা পড়েছে। কিন্তু ঘরে যে শাশুড়ি মা ছিলো তা একবারও বুঝতে পারিনি। 


--" সকালে আপনি আলভি আর নীলিমার সাথে কথা বলেছিলেন মা?"


--" হ্যাঁ রে মা। আমি আর নীলিমা বসে কথা বলছিলাম। পরে আমি আলভিকে কল দিয়ে বলি নীলিমা আমাকে বলেছে যে ও তানিয়াকে এই বাড়িতে দেখতে চায় না। আলভির সাথে ভালো ভাবে সংসার করতে চায়। ' এ কথা শোনার পর আলভি কল কেটে দেয়। তারপর বাড়ি চলে আসে। আলভি সদর দরজা দিয়েই নীলিমার নাম ধরে ডাকতে থাকে। তারপর ওরা আমার কাছে যায়। আমি আলভিকে বলি দরজাটা আটকে দিতে, আলভি রাগ করে দরজা আটকে দেয়। তারপর কড়া গলায় নীলিমার কাছে জানতে চায়, নীলিমা এমন কেন বলেছে! কিন্তু নীলিমা তো এমন কথা বলেনি তাই অস্বীকার করে। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। "


আমি হতভম্ব হয়ে শাশুড়ি মা'য়ের কথা শুনছি। এ তো সিরিয়ালের শাশুড়ির মতো তালবাহানা করছে। শাশুড়ি মা কিছু সময় চুপ করে থেকে আবারও বলে ওঠে, " মা রে সারাদিন সংসারের এসব কুট কাঁচালি দেখতে দেখতে আমিও কবে অমানুষ হয়ে গেছি নিজেও বুঝতে পারিনি। নিজের পছন্দ অপছন্দের থেকে বড় ব্যাপার হলো সন্তানের ভালো থাকা। সন্তান যার সাথে ভালো থাকে তাঁকেই মেনে নেওয়া উচিত। তুই আমাকে মাফ করে দে মা। যে করে পারিস আলভিকে আমার কাছে এনে দে। ও ছাড়া তো দুনিয়ার কেউ নেই আমার। "


শাশুড়ি মা কথাগুলো বলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমিও উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। না জেনে বারবার আলভিকে ভুল বুঝেছি। আসলে আমাদের চিন্তা ধারণা এখন নেগেটিভ হয়ে গেছে। আমরা ভালো কোনো জিনিসকেও ভালো মনে করতে পারি না। সন্ধ্যার প্রহর শেষ হয়ে রাত শুরু হলো। আলভি এখনও বাড়িতে আসেনি। বারবার সদর দরজার কাছে গিয়ে দেখতে লাগলাম আলভি এসেছে কিনা কিন্তু আলভির কোনো খোঁজ পেলাম না। 

সারারাত নির্ঘুম কেটে গেলো। ফজরের নামাজ পড়ে আল্লাহ কাছে সাহায্য চাইলাম।


--" হে আল্লাহ আপনি ছাড়া আমাকে সাহায্য করার আর কেউ নেই। আপনিই তো বলেছেন আপনার রহমত থেকে নিরাশ না হতে, আমি আপনার রহমত ভিক্ষা চাচ্ছি। "


নামাজ শেষ করে বাগানে চলে এলাম। প্রায় দিন সকালে আলভির সাথে এখানে আসতাম। আজ আলভি আমাকে ভুল বুঝে আমার থেকে কত দূরে চলে গেছে। আমিও আলভিকে ভুল বুঝে কত দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। কোথায় যেতে পারে ছেলেটা। আচ্ছা নদীর পাড়ে যায়নি তো? আমাকে নিয়ে প্রায়ই নদীর পাড়ে ঘুরতে যেতো। হয়তো সেখানে গিয়ে বসে আছে। পরমুহূর্তেই মনে হলো একটা মানুষ সারারাত কি নদীর পাড়ে বসে থাকবে নাকি! এ কি নাটক সিনেমা যে প্রেমিকার জন্য সারারাত দিন সেই জায়গায় অপেক্ষা করবে যেখানে তারা আগে সুন্দর সময় কাটাতো। আবার যেতেও তো পারে, এসব নাটক সিনেমা আমাদের মস্তিষ্কের উপর অনেক প্রভাব ফেলে, আমরা নাটক সিনেমার মতো চলতে চেষ্টা করি। গিয়ে দেখতে তো দোষ নেই। পেলে তো আলহামদুলিল্লাহ না পেলে কি আর করবো। কিন্তু আমার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো না। একা যেতেও সাহস হচ্ছে না। নাহ্ এখন নিজের কথা ভাবলে হবে না আলভিকে খুঁজে বের করতে হবে। শাশুড়ি মা মনে করছে আলভি তার কথায় কষ্ট পেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, গতকাল রাত থেকে একদম মুষড়ে পড়েছে। 


ঘরে গিয়ে বোরকা হিজাব পরে নিলাম। ব্যাগে টাকা আছে কিনা চেক করে, ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হতেই নীলিমা প্রশ্ন করলো, " আপু কোথায় যাচ্ছেন?"


--" আলভিকে খুঁজতে,  এভাবে বসে থাকলে ও-কে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আলভি অনেক জেদি একটা ছেলে। মা বাবার উপর রাগ করে বাড়ি ছাড়ার রেকর্ডও তার আছে। "


নীলিমা আমার কথায় মুচকি হাসলো। তারপর বললো, " আপনার শরীর তো ভালো না। আপনার একা যেতে হবে না। আপনি বরং কয়েক মিনিট অপেক্ষা করেন। আমি বোরকা হিজাব পরে আসি। আমিও আপনার সাথে যাবো। "


আমি মুখে কিছু বললাম না। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। নীলিমা দৌড়ে গিয়ে বোরকা হিজাব পরে আসলো। তারপর দুইজন শাশুড়িকে বলে বের হয়ে আসলাম। জীবনে প্রথমবার শাশুড়ি মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর চোখের পানি মুছে ঘরের ভিতর চলে গেলেন। একটা রিকশা ডেকে আমরা দুইজন রিকশায় উঠে গেলাম। নদীর পাড়ে যাবো। আল্লাহ চাইলে আমি আলভিকে পেয়েও যেতে পারি। চেষ্টা করতে ক্ষতি কি! আল্লাহ কুরআন শরীফে বলেছেন,


--' মানুষ যা চায়, তাই কি সে পায়?' ( সূরা নাজম, আয়াত -২৪) 


--" মানুষ তাই পায় যা সে চেষ্টা করে। ( সূরা নাজম, আয়াত -৩৯)  


রিকশার হুট খোলা, বাতাসে কাপড় উঠে যাচ্ছে। খুব সুন্দর অনুভূতি। কিন্তু তাও কিছু ভালো লাগছে না। চোখের সামনে শুধু আলভির আর আমার সুন্দর মুহূর্তগুলে ভেসে উঠছে। আলভির সাথে রিকশায় বসলে সবার চোখের আড়ালে আমার হাতটা ধরে থাকতো। 


--" মামা রিকশাটা থামান প্লিজ। দয়া করে আমার কথাটা শোনেন একটু।"


নীলিমার চিৎকার শুনে রিকশাওয়ালা মামা গাড়ি দাঁড় করালেন। নীলিমা কিছু না বলে রিকশা থেকে নেমে ছুট লাগালো। আমি কিছু বুঝতে না পেরে ও-র পিছন পিছন দৌড় দিলাম। রিকশাওয়ালা মামা হতভম্ব হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কয়েকবার ডাক দিলেন কিন্তু আমি ফিরলাম না। নীলিমা দৌড়ে একটা ছেলের কাছে গেলো। ছেলেটা রাস্তার পাশের ডাস্টবিন থেকে ময়লা ভেনে তুলছে। 


--" নীলয়!"


নীলিমার গলা শুনে ছেলেটা ও-র দিকে তাকলো তারপর দুইজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না, এটা নীলিমার স্বামী। ও কত সহজেই ও-র বরকে খুঁজে পেয়ে গেলো আমিও যদি আলভিকে এমন করে খুঁজে পেতাম। এমন সুন্দর মুহুর্তেও আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। 













এমন সুন্দর মুহুর্তেও আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমিও যদি আলভিকে খুঁজে পেতাম আজ। আমি ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই সময়ে ওদের বিরক্ত করা উচিত হবে না। আমি চুপচাপ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। নীলিমা নীলয়ের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ওকে প্রশ্ন করলো, " তুমি ঠিক আছো? আমি সেদিন তোমাকে খুঁজে পাইনি। জানো কত কিছু হয়ে গেছে!"


নীলয়ের চোখে পানি টলমল করছে। একহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো, " আমার পা ভেঙে গেছে রে নীলিমা। এই দেখো ব্যান্ডেজ করা। "


নীলিমা নীলয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল। সত্যিই ওর ডান পায়োর বেশ খানিকটা জায়গা ব্যান্ডেজ করা। নীলিমা ব্যস্ত হয়ে বললো, " কি হয়েছো তোমার? আর এ অবস্থায় কাজ কেন করছো?"


নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, " তোমাকে যেদিন বাসস্ট্যান্ডে আনতে যাবো সেদিন যাওয়ার পথে আমার এক্সিডেন্ট হয়। মোবাইলটাও হারিয়ে যায়। তুমি তো জানো আমি সামান্য ব্যাথাও সহ্য করতে পারি না। এক্সিডেন্টের পরে আমার চোখ খোলে হাসপাতালে কিন্তু এই অবস্থায়! জ্ঞান ফেরার পর মনে পড়ে তোমাকে আনতে যাওয়ার কথা। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে তোমাকে আর খুঁজে পাইনি। এদিকে আমার কাছে মোবাইলও নেই, মানিব্যাগটাও হারিয়ে গেছে। তোমাকে নিয়ে সব জায়গায় ঘুরবো বলে সব টাকা নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম। আমার কাছে কোনো টাকাও নেই, মোবাইলটাও নেই যে তোমাকে কল দিবো। কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এদিকে একটু হাঁটার কারণে পায়েও অনেক ব্যাথা হয়। সারারাত ব্যাথার জ্বালায় কেঁদেছি। আজ সকালে তোমাকে একটা নম্বর থেকে কলও দিছিলাম কিন্তু রিসিভ করোনি। হয়তো নম্বর চেনো না তাই। সকালে কাজে এসেছি টাকা পেলে সীম কার্ড তুলে তোমাকে কল দিবো তাই। "


নীলিমার চোখেও পানি টলমল করছে। এরা দুইজন দু'জনকে কত ভালোবাসে। নীলিমার এতো সময় পর আমার দিকে খেয়াল এলো। নীলয়কে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। 


--' নীলিমা তুমি নীলয়কে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলো। "


--" কিন্তু কাজ কে করবে?"


নীলয়ের প্রশ্নের জবাবে বললাম, ' কাজ করতে হবে না। মালিককে কাজটা ফিরিয়ে দেও আর তোমার নীলিমাকে তো পেয়ে গিয়েছো এখন আর টাকা লাগবে না। '


নীলয় পাশে দোকানে বসা একটা লোকের সাথে কথা বলতে গেলো। হঠাৎ মনে পড়লো। নীলিমা যেদিন এসেছিলো সেদিন থ্রি পিচ পরে ছিলো। আজ হঠাৎ বোরকা হিজাব কোথায় পেলো! প্রশ্নটা মনে আসতেই নীলিমাকে বললাম, " আচ্ছা নীলিমা তুমি বোরকা হিজাব কোথায় পেলে? তুমি তো সেদিন থ্রি-পিস পরে এসেছিলে। "


--" আপনার শাশুড়ি মা দিয়েছে আমাকে। প্রথমদিন উনি আমাকে এই বোরকা আর হিজাব দিয়ে বলেছিলেন এখন থেকে জানি আমি বোরকা হিজাব পরি। মেয়েদের উপর আল্লাহ পর্দা করা ফরজ করেছেন। এখন যদি অবহেলা করে এসব মেনে না চলি আর যদি আল্লাহ পরকালে এর জন্য শাস্তি দেন তখন কি করবো। তাছাড়া একজন মুসলিম হিসাবে তো আমার এসব বিধান মেনে চলা উচিত। আপনার শাশুড়ি কেমন মানুষ আমি জানি না। তবে উনি কথাগুলো আমার ভালোর জন্যই বলেছেন, তা-ই ভাবলাম এখন থেকে বোরকা হিজাব পরে চলবো। বোরকা হিজাব পরলেই ভালো হয় না এটা ঠিক। কিন্তু নিজের ধর্মের ফরজ বিধান লঙ্ঘন করে কি কেউ ভালো হতে পারে বলেন? এটা আমি এতোদিন বুঝতে পারিনি। আপনার শাশুড়ি মা'ই আমাকে বুঝিয়ে বলেছে। "


নীলিমার কথায় মুচকি হাসলাম। শাশুড়ি মা সকলের সাথেই কত ভালো ব্যবহার করে। শুধু আমাকে-ই কেন দেখতে পারে না কে জানে। নীলয় ও-ই লোকটার সাথে কথা বলে চলে আসলো। তারপর আমাদের কাছে এসে বললো, " উনার থেকে কাজটা নিয়েছিলাম। সব কাজ করে দিলে ২০০ টাকা দিবে বলেছিলো। চলেন এখন কোনো কাজ নেই। 


নীলিমা আর নীলয় এক রিকশায় উঠলো। আর আমি অন্য এক রিকশায়। অনেকদিন পর দেখা হয়েছে ওদের, একসাথে একটু সময় কাটালে ভালো লাগবে ওদের। রিকশায় বসে আলভির কথা ভাবতে লাগলাম। নদীর পাড়ে কি আমি সত্যি ও-কে পাবো?


কিন্তু না আমার ইচ্ছে পূরণ হয়নি। আলভিকে কোথাও পেলাম না। এক বুক হতাশা নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলাম। কিছু ভালো লাগছে না। গেস্ট রুমে নীলয় আর নীলিমাকে থাকতে বলে আমি ঘরে চলে আসলাম। শাশুড়ি মা তখন নিজে ঘরে শুয়ে ছিলেন। তাঁকে আর কিছু বলা হলো না। ঘরে ঢুকে বোরকা হিজাব খুলে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। জ্বর হয়তো আবারও আসবে। চোখ বুঁজে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে গেলাম নিজেও জানি না। চোখ খুলে দেখলাম কেউ একটা আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।


 


বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ আগে। ঘরের ভিতরও অন্ধকার। লোকটার মুখটা দেখতে না পারলেও এই স্পর্শের সাথে আমি অনেক পরিচিত আর এই মানুষটাও আমার চিরচেনা। খাটের উপর উঠে বসলাম। আলভি আমার দিকে ঘুরে তাকালো। ও কিছু বলবে এর আগে আমি ও-কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। আলভি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, " কাঁদছো কেন শুনি? এই তো আমি। "


--" আপনি অনেক খারাপ। আমাকে রেখে চলে গেছিলেন। কেউ নতুন বউ নিয়ে আসলে কি আগের বউটা ঠিক থাকতে পারে নাকি?"


আলভি আমার কথায় মুচকি হাসলো। তারপর এক হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমাকে ও-র কাছে নিয়ে গেলো। কিন্তু আমার এই প্রেম একদম ভালো লাগছে না। খুব রাগ হচ্ছে। প্রিয় মানুষের উপর কখন কখন যে অভিমান হয় আমরা নিজেরাও ঠিক বলতে পারি না। আমি ও-র থেকে সরে আসতে চেষ্টা করলাম।  কিন্তু সে আমাকে আরো শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরলো। 


আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, " আমার উপর অভিমান করো না প্রিয়, আমি বুঝতে পারিনি তুমি জানতে না এসব কিছু। আমি তো ভেবেছি তুমি সব জানো। "


আমি অবাক হয়ে আলভিকে প্রশ্ন করলাম, " আপনাকে এসব কে বলেছে?"


আলভি মুচকি হেসে বললো, " আমার শাশুড়ি মা। "


আমার মা আলভিকে এসব কি করে বললো। আলভির মোবাইল তো বন্ধ ছিলো।


--" আপনাকে মা কোথায় পেলো শুনি?"


--" মেয়েরা তো রাগ করে বাপের বাড়ি যায়। কিন্তু ছেলেরা তো বাপের বাড়িতে থাকে, তারা আর কই যাবে বলো, শশুর বাড়ি গিয়েছিলাম। তুমি বুঝতেই পারতে না আমি কোথায়! "


কথাগুলো বলেই আলভি হো হো করে হাসতে লাগলো। আমার এখন আরো বেশি রাগ হচ্ছে। আমি আলভির হাতের কাছের শার্ট খামছে ধরে বললাম, " গেছিলেন তো ভালো কথা, আবার ফিরে এসেছেন কেন হুহ?"


আলভি শয়তানি হাসি দিয়ে বললো, " বউয়ের কথা মনে পড়েছে, এই বর্ষায় রোমান্টিক আবহাওয়ায় কি বউ ছাড়া বেশিদিন ভালো লাগে নাকি?'


--" দেখেন মজা ভালো লাগছে না। আর আপনি মা'য়ের কাছ থেকে এসব জানলেন কি করে মা'কে তো আমি কিছু বলিনি। "


--" তুমি বলনি। মা নাকি বিকালে কল দিয়ে অনেক কান্না করেছে, তুমি নাকি আমাকে খুঁজতে গেছো, এসব শুনেই এসেছি। বাড়িতে আসার পরে নীলিমার কাছেই সব শুনলাম। আমি কি করে জানবো কেউ এসএমএস সিন করে কিন্তু ভয়েস রেকর্ড শোনে না। "


--" ওহ! ভালো হইছে আমি না হয় শুনিনি। তবে আপনি বাসরঘরে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন কেন?"


--" ওরে্ ভাই একটু নাটক সিরিয়ালের মতো ঢং করতে গেছিলাম। কে জানতো সে আপনি জানেন পারেননি কিছু। "


--" আপনার এতো ঢং করা লাগে কেন শুনি?"


--" বউয়ের সাথেই ঢং করতে হয়। আমার কি আর বউ আছে নাকি যে তার সাথে ঢং করবো?"


আমি রাগী গলায় বললাম, "আরো বউয়ের শখ আছে নাকি?"


আলভি কিছু না বলে আমার কপালে চুমু এঁকে দিলো। তারপর ও-র দুই হাত দিয়ে আমার মুখ ধরে বললো," না এই একটাকে নিয়েই জান্নাতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে৷ আর কাউকে চাই না। "


আমি উত্তরে কিছুই বললাম না। শুধু আলভিকে জড়িয়ে ধরলাম। আলভিও আমাকে ওর বুকের মাঝে আগলে নিলো। সব বাঁধা বিপদ শেষ করে আমরা আবার এক হয়ে গেছি। স্বামী স্ত্রী সম্পর্কে ঝগড়া ঝামেলা থাকবেই তা-ই বলে জেদ করে আলাদা হয়ে যাওয়া কোনো সমাধান না। আর এই ঘটনায় আলভির যেমন দোষ ছিলো আমিও খুব একটা নির্দোষ ছিলাম না। এসএমএস সিন করা দেখলে তো যে কেউ ভাবতো আমি সব জানি। এমন কি আমিও তাই ভাবতাম। সব ভুলবোঝাবুঝি মিটে আমরা আবারও এক হতে পেরেছি এটাই আলহামদুলিল্লাহ। প্রিয় মানুষটাকে নিজের কাছে রাখার থেকে বড় আনন্দের কিছুই হতে পারে না।









সকালে চোখ খুলে দেখলাম আমি আলভির বাহুর মাঝে আবদ্ধ হয়ে আছি। নিজেকে সত্যি ভাগ্যবতী মনে হতে লাগলো। আলভিকে না জেনে অনেক ভুল বুঝেছি আমি। আলভিও যে আমাকে ভুল বোঝেনি এমনটা নয়। তবুও প্রিয় মানুষের কাছে দোষ স্বীকার করে নেওয়ার মাঝে কোনো লজ্জা নেই। আলভির বাহুর বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে অজু করে আসলাম। নামাজে দাঁড়াবো এমন সময় আলভি বলে উঠলো, " আমাকে রেখে নামাজ পড়বে নাকি? দাঁড়াও আমিও অজু করে আসি। দুইজন মিলে জামায়াতে নামাজ পড়বো। "


আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। তারপর জায়নামাজে বসে ও-র জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আলভি অজু করে আসার পর দু'জনে মিলে নামাজ শেষ করলাম। একদম আগের মতো করে, নামাজ শেষ করে দুইজনে মিলে বাগানে গেলাম। সকালের শান্ত পরিবেশটা আমার বরাবরই অনেক পছন্দের। আর আজকে তো আলভি সাথে আছে। দু'জনে মিলে খুব ভালো সময় কাটালাম। কিছু সময় পর আলভি ঘরে এসে কিসব কাজ করতে লাগলো। আর আমি রান্নাঘরে চলে গেলাম। অনেকদিন বাড়িতে ভালো-মন্দ রান্না করা হয় না। আজ সকাল সকাল একটু ভালো কিছু নাস্তা বানাবো ঠিক করলাম। ফ্রিজ থেকে গরুর গোশত বের করে ভিজিয়ে রাখলাম, তারপর ময়দা মেখে বেশ কতগুলো পরোটা বানিয়ে নিলাম। পরোটা বানানো হয়ে গেলে গোশতটা রান্না করে ফেললাম। এটা দিয়ে সকলের খাওয়া হয়ে যাবে। শাশুড়ি মা সকালে ভর্তা ভাত খেতে খুব পছন্দ করে, তাই তার জন্য ডিম ভর্তা আর বেগুন ভর্তা করলাম, সে-ই সাথে গরম ভাত। রান্না শেষ করতে প্রায় নয়টা বেজে গেলো। 


খাবারে টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে এলাম। নীলয় আর নীলিমাও আজ বেশ খুশি আছে। তবে নীলয়ের কপালে চিন্তার ভাজ! বাইরে থেকে খুশি দেখালেও ভেতরে ভেতরে হয়তো অনেক চিন্তায় আছে। কিন্তু নিজের চিন্তা নিজের মাঝে সীমাবদ্ধ রেখে নীলয় সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করছে। শাশুড়ি মা সবটা জানার পর হেসে কুটিকুটি হচ্ছেন। এ যেন তার সিরিয়ালের সাথে মিলে গেছে। খাওয়া শেষ করে নীলয় আলভিকে উদ্দেশ্য করে বললো, " ভাইয়া আপনার সাথে কিছু কথা আছে। একটু বাইরে আসবেন প্লিজ। "


আলভি কিছু না বলে নীলয়কে নিয়ে বাগানে চলে গেলো। নীলয় আর আলভির পিছন পিছন আমি আর নীলিমাও গেলাম। আমাকে অবশ্য নীলিমাই ডেকে নিয়ে আসলো। সকলে এক জায়গায় হওয়ার পর নীলয় বললো, " আলভি ভাই আমি নীলিমার কাছ থেকে সবকিছু শুনেছি। আপনাদের এই বিয়ের কি করবেন?  আসলে আমি এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না। তা-ই আপনাকে প্রশ্ন করলাম। "


আলভি শান্ত গলায় বললো, " আসলে নীলয়  আমার সাথে নীলিমার বিয়েটাই হয়নি। তা ইসলামি মতে বলো বা দেশীয় আইনে বলো। আগের স্বামী স্ত্রী সাথে তালাক বা ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত কারো সাথেই পুনরায় বিয়ে হয় না।"


নীলয় কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো, " তবুও যদি কিছু করা লাগে, আসলে আমি নীলিমাকে হারাতে চাই না। বা নীলিমার ভাগও কাউকে দিতে চাই না। "


নীলয়ের কথা শুনে নীলিমা মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। সারা মুখ রক্তিম আভাতে ছেয়ে গেছে। হয়তো লজ্জা পেয়েছে। আলভিও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। সে-ও যেন নীলয়ের বলা কথাগুলো আমাকে বলতে চায়। আমিও আলভির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। তারপর লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। 


আলভি নীলয়ের ধাড়ে হাত রেখে বললো, " শোনো নীলয়,


অন্য পুরুষের বিবাহে থাকা স্ত্রীও অপর পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ।


বিবাহিতা নারীরা নিশ্চিত ও কার্যকরী পন্থায় তালাকপ্রাপ্তা/বিধবা হয়ে ইদ্দত পালনের আগে দ্বিতীয় কোন পুরুষের ঘরণী হতে পারবেনা। এটাই আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা। 


কোরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, এবং সব সধবা নারীরাও বিবাহের ক্ষেত্রে তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ। (সূরা নিসা, আয়াত-২৪) 


কোন বিবাহিতা নারী যদি তার স্বামীর পক্ষ থেকে তালাকপ্রাপ্তা হন এবং তিন মাস (তিনটি পিরিয়ড) ইদ্দত পালন শেষ করেন শুধুমাত্র তাহলেই তিনি নতুন করে বিবাহের বৈধতা পাবেন। 


এ ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সুস্পষ্ট নির্দেশ, আর তালাকপ্রাপ্তা নারীরা নিজেদেরকে অপেক্ষায় রাখবে তিন হায়েজ পর্যন্ত। (সূরা বাকারা, আয়াত-২২৪) 


বিবাহ যেহেতু আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্দেশিত একটি ধর্মীয় রিচুয়াল। তাই তার নির্দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করলে সেই বিবাহ শুদ্ধ হিসেবে গন্য হবেনা। 


এখন কারো যদি পূর্বের স্বামীর সঙ্গে শরীয়তসম্মতভাবে ছাড়াছাড়ি না হয়ে থাকে, তাহলে কোনভাবেই এ বিয়ে বৈধ নয়। তবে এর জন্য দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।


প্রথম বিষয় হলো, প্রথম স্বামীর ছাড়াছাড়িটা ইসলামী শরীয়ত সম্মতভাবে হয়েছে কি-না। আর তালাকনামা পাঠানো এবং সেটি ইসলামী শরীয়ত সম্মতভাবে বিয়ে বিচ্ছেদ হওয়া পর্যন্ত পৌঁছেছে কি-না, এই বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।


আররেকটি হলো, যদি শরীয়তসম্মতভাবে ছাড়াছাড়ি বা বিচ্ছেদ হয়ে থাকে, তবুও তিন মাস অথবা তিন পিরিয়ডের সময় পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হবে। সেটি হয়েছে কি-না নিশ্চিত করতে হবে। 


এই দুটি বিষয়ের কোন একটি বিষয় যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে বিয়ে শুদ্ধ হবে না। বরং এটি একটি অবৈধ বিয়ে। 

আবার দেখো

যে নারীকে বিয়ে দেওয়া হবে সে কুমারি হোক কিংবা তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা হোক সবার ক্ষেত্রেই বিয়ে দেওয়ার আগে মতামত নেওয়া বা অনুমিত গ্রহণ করা আবশ্যক। যিনি অভিভাবক হবেন তার জন্য অবশ্যই নারীর কাছ থেকে বিয়ের আগে অনুমতি বা মতামত গ্রহণ করা জরুরি। কোনো নারীর মতামতের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাত্রস্থ করা বা বিয়ে দেওয়া বৈধ নয়।


আবার যদি কোনো নারীর অনুমতি ও সম্মতি ছাড়াও তার বিয়ে দেওয়া হয় তবে সে নারী চাইলে তার বিয়ের আকদ বা চুক্তি বাতিল করতে পারবে।  আবার বিয়ে বাতিলেরও অধিকার রাখে নারী।


হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সায়্যিবাহ (আগে বিয়ে হয়েছে এমন তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা) বিবাহিতা নারীর মতামত বা সম্মতি গ্রহণ ছাড়া তার বিয়ে দেওয়া যাবে না এবং কুমারী নারীকে তার অনুমতি ব্যতিতও বিয়ে দেওয়া যাবে না।’ 


তারা (সাহাবায়ে কেরাম) বললেন, কুমারী নারীর অনুমতি আবার কিভাবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তার চুপ থাকাই অনুমতি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস, ৫১৩৬)


এখানে এই বিয়েতে আমার বা নীলিমার কারোই মতামত ছিলো না। সে-ই জন্য এই বিয়েটা বৈধ নয়। ধরতে গেলে বিয়েই হয়নি। এছাড়া আমাদের দেশের আইনেও এ কথা বলা আছে।

মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, প্রথম স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাবস্থায় স্ত্রী যদি পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে সেই দ্বিতীয় বিয়ে অবৈধ, অকার্যকর ও বাতিল বলে গণ্য হবে। স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে ইচ্ছুক হলে তাঁকে আবশ্যিকভাবে আগে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুসারে প্রথম স্বামীকে তালাকের নোটিশ প্রদানপূর্বক ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হওয়া সাপেক্ষে নির্দিষ্ট ইদ্দতপালন শেষে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করা যেতে পারে। এই বিধান লঙ্ঘন করে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়ে বলবৎ থাকাবস্থায় স্ত্রী যদি স্বামীর জিম্মা থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেন  সেক্ষেত্রে প্রথম স্বামী সেই স্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে পারেন। সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত স্ত্রী বাংলাদেশের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড পেতে পারেন। সঙ্গে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। এ ব্যাপারে আমরা কোর্টে গিয়ে সমাধান করে নিবো।"


আলভি এক নাগাড়ে সব কথাগুলো বললো। নীলয় খুব মন দিয়ে আলভির কথা শুনছে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে আলভির দিকে তাকিয়ে আছি।আমার বরটা কতকিছু জানে। তবে কেউ কোনো বিষয় না জানলে তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা বা উপহাস করা উচিত নয়।  সবাইকে সবকিছু জানবে এমনটা নয়৷ আলভি কথা শেষ হলে নীলয় যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।


(বিয়ের ব্যাপারে আমি যতটুকু জানি ততোটুক লিখেছি, ভুল হলে ধরিয়ে দিবেন। এ ব্যাপারে আমার বিশেষ জ্ঞান নেই।) 


আমিও খুব খুশি। নীলয় আলভির হাত ধরে আলভিকে ধন্যবাদ দিলো। আজকেই ওরা চলে যাবে, আমরা অনেক বলার পরও থাকতে রাজি হলো না। নীলয়ের পায়ের ব্যাথা অনেকটা কমে গেছে। কথা শেষ করার পর নীলয় নীলিমার হাত ধরে ঘরের দিকে যেতে লাগলো। আমি আর আলভি বাগানের ভিতর দাঁড়িয়ে আছি। ওরা দৃষ্টির আড়াল হতেই আলভি আমার দিকে এগিয়ে আসলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে ও-র দিকে তাকিয়ে আছি। কি করতে চাইছে এই ছেলে। আলভি আমার কাছে এসে আমার দুইহাত ধরে বললো, " আমার ভুল হয়ে গেছে, ওদিন তোমাকে বাড়ি ফিরে সবটা খুলে বলা উচিত ছিলো। তাহলে আর এতো কিছু হতো না।"


আমি ইশারায় আলভিকে চুপ করতে বললাম। আলভি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মুচকি হেসে বললাম, " দোষটা আমাদের দুইজনেই, তাই কেউ কারো কাছে মাফ চাইবে না। আল্লাহ আমাদের মিলিয়ে দিয়েছে এটাই অনেক। "


আলভি তানিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আমৃত্যু টিকে থাকুক পবিত্র সম্পর্কগুলো। 



সমাপ্ত


নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম