উৎসর্গ ।লেখিকা:শবনম মারিয়া ।

 ১২ বছর ধরে মাহিরা এই সংসার করে যাচ্ছে। এই ১২ বছরে স্বামীর কম ভালোবাসা পেয়েছে এমনটা নয়। সে তার স্বামীর কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা পেয়েছে এই সাংসারিক জীবনে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে আজকাল। সে আর খুশি নেই তার সাংসারিক জীবনে। এর কারণ অবশ্য তার স্বামী সফিক। সফিক আর আগের মতো মাহিরাকে সময় দিতে চায় না। মাহিরাকে আগের মতো ভালোবাসে না৷ কেন যেন তার মন উঠে যেতে লাগলো মাহিরার উপর থেকে।

মাহিরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে সম্পর্কটাকে আগের মতো করার। কিন্তু হয় না। ইদানিং তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। মাহিরার মাঝে মাঝে নিজেকে অসহায় লাগে। তার দুই ছেলে মেয়েকে নিয়েও সময় কাটাতে পারে না। ছেলে মেয়েরা লেখা পড়া নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকে। তাই মাহিরাকেও সারাটাদিন ব্যস্ত থাকতে হয় সংসারের কাজ নিয়ে।
আজ কি যেন হলো মাহিরার। তার আর রান্না করতে ভালো লাগছে না৷ কোনো কাজ করতে ইচ্ছা করছে না। তার হঠাৎ খুব বই পড়তে মন চাচ্ছিলো। ড্রয়িংরুমের সেল্ফ ভরা অনেক বই। মনে পরলো একসনয় সে অনেক বই পড়তো। মাঝে মাঝে কিছু একটা লিখেও ফেলতো। বন্ধুমহলে তার নাম হয়ে উঠেছিলো 'লেখিকা'। আজ হঠাৎ এগুলো ভেবে হেসে ফেললো সে। পরক্ষণেই তার মনে পরলো, "পূরনো কথা ভেবে কি লাভ। যাই রান্না করি। বাচ্চারা, তার স্বামী কি খাবে সে যদি রান্না না করে?
কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই মাহিরাকে ফোন করলো সফিক। সে ফোন করে জানালো আজ সে বাড়ি আসতে পারবে না। এক সপ্তাহের জন্য অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে যেতে হচ্ছে তাকে। মাহিরা কতক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। এরপর ভাবলো আজ আর সে রান্না করবে না। ছেলে মেয়ের জন্য বাহির থেকে খাবার ওর্ডার দিয়ে আনালো। মাহিরা রান্না রেখে বই পড়া শুরু করলো। বেশ কয়েকদিন বই পড়তে পড়তে সে এরপর সামাজিক মাধ্যমেও গল্প পড়তে শুরু করলো। এরপর তার হঠাৎ মাথায় আসলো, সবাই যেহেতু ফেসবুকে লিখে, সে লিখলেও হয় তো কেউ পড়বে। মাহিরা যখন ফেসবুকে লেখালেখি শুরু করে তখন পরিবারের কেউ জানতো না৷ তার স্বামীও না।
অন্যদিকে মাহিরা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে দুটো উপন্যাস লিখে। সে বেশ কয়েকটা কবিতা, ছোট গল্পও লিখেছে। হঠাৎ ফেসবুকই তার পরিচয় হয়ে যায় তার এক কলেজ জীবনের বন্ধুর সাথে। সে একজন প্রকাশক। প্রকাশক হিসেবে তার বেশ খ্যাতি আছে। সে মাহিরাকে অনেক জোর করলো বই বের করার জন্য। মাহিরা ভাবলো বিষয়টা এবার তার স্বামীকে জানাবে।
মাহিরা তার স্বামীকে যখন তার এই বিশেষ খবরটি দিতে গেল ঠিক তখনই সফিক তার কথা না শুনে তার আগেই মাহিরার সাথে তাদের ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে বলল, "আমি ডিভোর্স চাই। আমি আর তোমার সাথে থাকতে চাই না। "
বিষয়টা মাহিরার মেনে নিতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু সে সফিকের কথা মতো তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।
আজ মাহিরার প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে। আর মাহিরার এই বইটি অজান্তে সফিককে তার বর্তমান প্রেমিকা গিফ্ট করেছে। সে সফিককে বইটি দিয়ে বলল, "এই লেখিকাটি ফেসবুকে লিখতেন। বেশ ভালোই লিখেন। তার প্রথম প্রকাশিত বই এটা। ভাবলাম তোমায় গিফ্ট করি।"
বইয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল মাহিরার ছদ্মনামে। কিন্তু বইটি খুলে যখন সফিক উৎসর্গপত্র পড়লো তখন তার বুঝতে দেরি হলো না।
উৎসর্গ পত্রে লেখা ছিল,
-সে অজান্তেই আমার অনেক উপকার করেছেন। সে আমাকে জীবনের অর্ধেক সময়ে এসে ছেড়ে না দিলে হয় তো আমি আবার লেখালেখি করতে পারতাম না। তার হয় তো মনে নেই বিয়ের পর আমার লেখা কবিতাগুলো শুনে সে বলেছিলেন, "খবরদার, তোমার লেখা এই কবিতাগুলো যেন আমি ছাড়া আর কেউ না পড়ে। কবিতাগুলো শুধু আমার, যেমন তুমি শুধু আমার। তোমার লেখা কবিতায় শুধু আমার অধিকার।"
তার এই কথায় আমি আর কাউকে আমার লেখা পড়তে দেইনি। কিন্তু তার জন্য যা লিখেছিলাম তাও তার আর পড়ার সময় হয় নি। ভাগ্যিস সে আমায় এতো সুন্দর করে ভালোবেসে তারপর এতো সুন্দর করে কষ্ট দিয়েছিলো। নাহলে আজকে আমি এই উপন্যাসটি লিখতে পারতাম না। ধন্যবাদ আপনাকে আমার প্রাক্তন স্বামী, সফিক আহমেদ।
নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম