পাওয়া না পাওয়ার গল্প। লেখিকা: মেঘপ্রিয়া জাহান।

 বাহ রাজ ! দারুণ তো। ভাগ্যিস তানু বলেছিলো তোমার দিকে নজর দিতে, তাই তো আজ সানায়া মাহমুদ আর অভি রাজ শেখ কে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখার সৌভাগ্য হলো । আমাকে দেখে রাজ আর সানায়া দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে যায়, হয়তো আমার উপস্থিতি আশা করে নি। রাজ আমাকে বললো,

- মেঘ তু-তু-তু-উউউউ-তুমি এখানে, এই সময়ে? তোমার তো নানু বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিলো আজ।
আমি বললাম,
- হ্যা ছিলো তো, গিয়েও ছিলাম। হঠাৎ কারোর বার্তা আসে । আমার সম্পদের উপর নাকি কারোর নজর পড়েছে। সেটাই দেখতে আসছিলাম। কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল ছিলো বার্তা টা। এখানে এসে দেখছি সম্পদ টাই আমার না। ব্যক্তিগত সম্পদ স্বেচ্ছায় নিজেকে অন্যের কাছে হস্তান্তর করেছে। তা অভি রাজ শেখ, কতদিন চলছে আপনাদের মধ্যবর্তী প্রণয়। আচ্ছা এটাকে প্রণয় বলবো নাকি প/র/কী/য়া??
আমার কথা শুনে সানায়া মাহমুদ এর শরীরে ২৪০ ভোল্টেজ কারেন্ট লেগে গেলো। সে আমাকে ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো,
- যেটাই করছি বেশ করেছি। তুমি তোমার স্বামীকে ভালোবাসা, সুখ-শান্তি দিতে পারো নাই , তাই সে অন্য নারীর মধ্যে সেগুলো খুঁজে পেতে চাইছে। আগে নিজের দোষ গুলো দেখো, ঠিক কোন কারণে তোমার স্বামী সানায়া মাহমুদ এর বাহুডোরে এসেছে! তারপর অন্যকে বলতে যেও তোমার বাক্যালাপ।
সানায়ার কথায় আমি নির্বাক, বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছিলাম রাজ এগুলো শুনেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একটা বাইরের মেয়ের মুখে আমার অপারগতার কথা শুনতে কি ওর কষ্ট হলো না! এমন বিশ্রী কটুক্তি আমাকে নিয়ে ও সহ্য করলো কি করে ? এতো দিনের সম্পর্ক আমাদের একটুতেই শেষ! আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। পুরো পৃথিবীর ভার যেন বুকের উপর দেওয়া হয়েছে, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। চোখের পানি গুলো বেহায়া হয়ে ঝরছে। কথাগুলো তো মেয়ে টা খুব একটা ভুল বলে নি। রাজের দিকে ফিরে ওকে বললাম,
- এতোটাই যখন অপারগতা ছিলো আমার মধ্যে মুখ ফুটে বলে দিলেই হতো। চোরের মতন এমন আড়ালে, অগোচরে লুকিয়ে কারোর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে , আমাদের সম্পর্ক কে এতোটা অসম্মান আর অপবিত্র না করলেই হতো। আমার কাছে যখন ভালোবাসা , সুখ- শান্তি কিছু পাচ্ছিলে না তাহলে বললেই হতো, স্বেচ্ছায় মুক্তি দিয়ে দিতাম। অন্তত আজ এই দিনটা জীবনে দেখতে হতো না, আর না শুনতে হতো একটা বাইরের মেয়ের কাছে নিজের সম্পর্কে বিশ্রী ইঙ্গিতময় কথা। আর তুমিই বা কেমন, নিজের স্ত্রী ঘরে না থাকার সুযোগে অন্য একটা মেয়েকে ঘরে ডেকে আনো সময় কাটাতে?
আর শুনুন মিস সানায়া মাহমুদ, আপনার সম্পর্কে ও আমি ভালো মত পোষণ করতে পারছি না। আপনি কি করে একটা ছেলের সাথে একাকী অবস্থান করতে আসেন? তাও তখন, যখন আপনি জানেন সে বিবাহিত। আমাদের মধ্যে যা কিছুই হোক, আমরা দুজনে মিটিয়ে নিতাম। আপনাকে কে বলেছে ভালোবাসা, সুখ-শান্তি বিলাতে। নাকি এটা আপনার প্রফেশন পর পুরুষ কে ভালোবাসা আর সুখ-শান্তি দিয়ে ভালো রাখা? আপনাদের মতো কিছু মেয়েদের জন্যই অনেক ভালো ভালো সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। কারো সম্পর্ক একটু খারাপ দেখলেই সেখানে আদা জল খেয়ে পিছনে পড়ে যান যেন সম্পর্কটা আরো খারাপ হয়। এভাবে চলতে চলতে সম্পর্কটাই চূড়ান্ত সময় এসে যায় বিচ্ছেদের, যেমন টা আজ আপনাদের জন্য এসেছে আমার জীবনে। এগুলো বলার মধ্যেই রাজ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ,
- মেঘ অনেক হয়েছে এবার থামো। সানায়া তুমি বাসায় যাও, আমাদের টা আমি দেখছি। সানায়া কে বিদায় দিয়ে রাজ আমার সামনে এসে বলে ,
- এতক্ষণ এসব কি বলছিলে, তুমি তো এসব বলার মতো মেয়ে না। কাউকে ছোট করে , কষ্ট দিয়ে তো তুমি কিছু বলতে না মেঘ। তাহলে আজকে তোমার বলা কথাগুলোর শব্দ এতোটা কঠিন কেন ?
- ওহ আচ্ছা, আমার বলা শব্দ গুলো কঠিন আর কষ্টদায়ক। বাহ! তা অভি রাজ শেখ আপনার সানায়া মাহমুদ এর বলা কথা গুলো খুব সুন্দর ছিলো? কই , তখন তো মুখ ফুটে কোনো বুলি আওড়ালেন না। আপনার স্ত্রীকে ছোট করে , অপমানজনক কথা আপনার কাছে কিছু মনেই হয় নি। আমার অপমানে আপনার কিচ্ছু যায় আসে না? আমাকে করা আঘাত গুলোর জন্য আপনার মধ্যে একটুও অনুতপ্ততা নেই? আচ্ছা, আপনার বুক কাঁপছে না, লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে আসছে না, আমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয় আপনাকে গ্রাস করে ফেলছে না ?? উপস! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আপনার আমাকে হারানোর ভয় কেন থাকবে, যেখানে ভালোবাসাটাই বিদ্যমান নেই। ভালোবাসা থাকলে এইভাবে ঠকাতে পারতেন না আমাকে। এইভাবে আমার বিশ্বাস ভাঙতেন না। এইভাবে আমাকে একা ও অসহায় মুহুর্তে দাঁড় করাতে পারতেন না। কথাগুলো বলতে বলতেই অঝোর কান্নায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি ফ্লোরে। রাজ ও আসে আমার কাছে । আমার চোখের পানি মুছে দেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই আমি ওর হাত ধরে বলি,
- আপনার কোনো অধিকারই নেই আমার চোখের পানি মুছে দেওয়ার জন্য। যেই হাত অন্য কাউকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে, ওই হাতের স্পর্শ আমার জন্য মৃ*ত্যু তুল্য লাগে এখন। জানেন তো মিস্টার শেখ, আজ বড্ড আফসোস হয় আপনাকে ঘিরে করা পাগলামির জন্য। বার বার, বার বার আঘাত পেয়েছি আপনার জন্য, সবকিছু ছেড়েছি শুধু আপনার জন্য, কথার দ্বারা ঘায়েল হয়েছি শুধু আপনার জন্য, পুরো পৃথিবী এক পাশে ফেলে আপনাকে নিজের পৃথিবী বানিয়ে নিয়েছি শুধু ভালোবাসার জন্য। আপনার কাছে কি এগুলোর আদৌ কোনো মূল্য আছে ? আমি আপনাকে ভালোবাসি বলেই বার বার শত আঘাতেও চুপ করে মুখে হাসি নিয়ে পড়ে থাকি আপনার মাঝেই। আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না বলেই নিরব কষ্ট গুলো দাফন দেই বুকে। আপনাকে ভালোবেসে পড়ে থাকি বলে কি এতোটাই সস্তা মনে হয় আমার ভালোবাসা, মানে এর কোনো মূল্যই নেই আপনার কাছে? কি দরকার ছিলো তাহলে ভালোবাসা প্রকাশ করার, এতো এতো অনুভূতি প্রকাশ করার? ভালোবাসার মানুষটির অসম্মান, কটুক্তি যদি আপনার হৃদয়ে আগুন না জ্বালায় কি ভালোবাসেন আপনি? আমার হাসির নিঃশব্দে ম/র/ণ যদি কষ্ট না দেয় আপনাকে , কি ভালোবাসেন আপনি আমায়? আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় যদি আপনার বুক কাঁপিয়ে না তোলে , তাহলে কি ভালোবাসেন আপনি আমায়?? এগুলো বলেই রাজের হাতটা অতি রাগান্বিত ভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেই। রাজ আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর মুখে হাসি নেই আর নেই কোনো বলার মতো শব্দ। আমাকে বাঁধা দেওয়ার মতো ও কোনো শক্তিই নেই বোধহয় ওর কাছে। তবু ও ঠোঁট মেলে বলতে শুরু করলো,
- মেঘ যা কিছু হয়েছে ভুলে যাও না। আমার দ্বারা অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে। আমি আর এমন ভুল হবে না। থেকে যাও আমার সাথে। তাছাড়া এখন তোমার মাথা গরম তাই এমন চিন্তা ভাবনা করছো। আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে বলো , আর তো কেউ নেই তোমার। আমার ভুলের জন্য ক্ষমা চাইছি মেহুরানী, আমার দ্বারা এ ভুল আর পুনরায় হবে না। আমি ও যে তোমাকে খুব ভালোবাসি মেহুরানী। রাজের কথা শুনে আমি তাচ্ছ্যিলের হাসি দিলাম । বললাম,
- কি বললে তুমি? ভালোবাসা, হা হা! ভালোবাসা কি আদৌ জানো তো রাজ ? আমাকে ভালোবাসলে আমার জায়গায় ওই মেয়েটাকে শক্ত বাঁধনে জড়াতে না। আমাকে ভালোবাসলে অন্যকে নিয়ে ভাবনা আসতো না। আমাকে ভালোবাসলে পর নারীর দিকে অন্য নজর আসা মাত্রই আমার মুখটা স্মরণ করতে। আমাকে ভালোবাসলে তোমার সামনে আমাকে কিছু বলার সাহস কারোর হতো না রাজ । শেষ আমাদের সম্পর্ক টা। তিলে তিলে গড়া ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা, নিরাপত্তা, আস্বস্ততা , চোখ বন্ধ করে আস্থা ও বিশ্বাস করা মানুষ টা সবকিছুই কয়েক মুহুর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে শেষ করে দিলো। ভালোবাসাময় অনুভূতিতে লেখা পাতা গুলোতে নিজ হাতে আগুন ধরিয়ে দিলো। ভরসার জায়গা টা ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। পূর্ণ হৃদয় টা অপূর্ণ আর চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফিরিয়ে দিলো। ভুল হলে ক্ষমা করা যায় রাজ কিন্তু অন্যায় তাও আবার এতোবড় ধোঁকাবাজির! এটা কিভাবে ভুলবো আমি, কি করে ক্ষমা সম্ভব? আর মেহুরানী নামটা তোমার মুখে শুনতে চাই না আমি। এই নামটার মৃ/ত্যু হয়েছে আজ, আর সেটা তুমি নিজ হাতে করেছো। এই নাম দ্বিতীয় বার যেন উচ্চারিত না হয় তোমার মুখে। আজ এই মুহূর্ত থেকে তোমার আমার পথ আলাদা। তোমার ছায়া ও মাড়াতে চাই না আমি। আর আমি কোথায় যাবো কোথায় থাকবো এই নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার জন্য আল্লাহ আছেন, তিনিই সব ব্যবস্থা করে দিবেন। বিশ্বাস করে আপনার হাত ধরেছি সারাজীবন ভালোবেসে একসাথে থাকার জন্য, কিন্তু এইভাবে আমার বিশ্বাস এর মর্যাদা দিবেন বুঝতে পারি নাই। সবকিছু ছাড়িয়ে আপনার ভালোবাসাতে অন্ধ হয়ে যাওয়া টা ঠিক হয় নাই আমার। আপনি কি ভেবেছেন, কি কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে , এইসব কিছু সহ্য করে আপনার কাছে থেকে যাবো? ভুল ভাবছেন মিঃ অভি রাজ শেখ, মেঘ এতোটা ও অসহায় নারী না যে অসম্মান নিয়ে পড়ে থাকবে। আপনি আমার ভালোবাসা ছিলেন, এখন নেই। আপনি আমার তাজ ছিলেন, এখন নেই। আপনি আমার সুখ পাখি ছিলেন কিন্তু সেটা চিরতরে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে আমার জন্য। আপনি আমার হৃদয়ে অবস্থান করতেন ভালোবাসা নিয়ে আর এখন.......! আন্তরিক ভাবে দুঃখিত মিঃ শেখ, এতোটাই গভীর ভালোবাসি যে কিছু কিছু শব্দ বুকটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে কিন্তু মুখ ফুটে বলা সম্ভব হচ্ছে না। আপনাকে খুব কষ্ট করেই ভালোবেসে পেয়েছিলাম‌। আজ দেখুন সেই কষ্টের ভালোবাসা নিয়েই হারাতে হচ্ছে। কি বলবো বলুন তো? আপনি আমার পেয়েও না পাওয়া অমূল্য সম্পদ। পূর্ণতার মাঝে ও অপূর্ণ ইচ্ছের ঘুড়ি। পাওয়ার মধ্যে ও হারানোর সুরে গাঁথা চিরসত্যের কাব্যলতা। পূর্ণ অপূর্ণের সেতুর এ পাশ ও পাশ যা আর মিলিত হবার নয়। আপনি আমার মনের ঝিনুকের দ্বারা আবৃত মুক্তোর খোলস মাত্র। ভালো থাকবেন তাকে নিয়ে যে আপনাকে আমার চেয়ে ও বেশি ভালোবাসবে আর সুখে রাখবে্। এই বলে রাজকে শেষ বারের মতো জড়িয়ে ধরে আর কপালে ভালোবাসার শেষ স্পর্শ এঁকে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে আসি ওরে ছেড়ে। দরজার ওপাশে এক পা বাড়িয়ে দিয়ে পিছন ফিরে শেষ বারের মতো দেখলাম তাকে, নিরলুপ্ত মুখটি আমার যাওয়ার পানেই হতাশা আর আফসোস এর চাহনিতে রয়েছে। মনে মনে নিজেকে শক্ত করে বললাম, এটা আপনার পাওয়ার ছিলো অভি রাজ শেখ। আমাকে হারাতেই হতো বিশ্বাস ভাঙার জন্য। আমার ভালোবাসা কে ছোট করার জন্য, অপমানিত করার জন্য। আপনি আমার পাওয়া না পাওয়ার গল্প হয়েই থাকুন। পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা কেমন হয় আপনি ও বুঝুন। ভালোবাসার মানুষটিকে হারানোর ভয় আপনার হোক, তার দেওয়া বিচ্ছেদ আপনাকে পাগল করে তুলুক। এই নিরব যন্ত্রণা কতটা ভয়ংকর আপনার বোঝা উচিত মিস্টার অভি রাজ শেখ। ভালো থাকুন আপনি , মেঘহীনা জীবন নিয়ে।
নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম