আরুশা নুরের রুপার গল্প।

 রুপাকে প্রথম দেখেই আমি বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়েছিলাম। ধবধবে সাদা জামদানী, লাল ব্লাউজ দিয়ে, মাথায় লাল হিজাব, চোখে কাজল। ভাল লেগেছিল তখনি। কিন্তু প্রেমে পড়েছিলাম রুপার সাথে আলাপ হওয়ার পর। কি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। রুপা তখন নতুন নতুন জয়েন করেছিল ওর কোম্পানিতে। এমবিএ করে এসেছে বিদেশ থেকে। তাই অল্প বয়সেই এতো বড় পদে জয়েন করতে পেরেছিল। ওর অফিসের অনেকেই ওর জন্য দিওয়ানা ছিল। কিন্তু মুখে কেউই ওকে কিছু বলতে পারেনি। আমি ছিলাম ইনকাম ট্যাক্সে সদ্য জয়েন করা টগবগে যুবক। রুপার চেয়ে বেতন আমার কম ছিল। কিন্তু আমি সরকারি চাকুরীজীবি, আর রুপার বেসরকারি চাকুরী। প্রেমে পাগল হয়ে বাবা মা কে সরাসরি বলেই দিলাম রুপার কথা। বিয়ের প্রস্তাব গেলো রুপার বাসায়। সব দিক দিয়ে সব কিছু ওকে। কাজি ডাকতে আর দেরী হয়নি।

বাসর রাতে প্রথম রুপার চুল দেখি। আরো একবার প্রেমে পডলাম। কোমরের নিচ পর্যন্ত একঝাঁক চুল। কি দারুন গন্ধ। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিলাম। আর রুপা নিজের নতুন রূপে আমাকে পরিচিত করতে ব্যস্ত। একটা আস্ত বাঁচাল মেয়ে রুপা। বিয়ের আগে এতো কথা বলতে দেখিনি রুপাকে। মেপে কথা বলতো। আর ওর সকল কথা ছিল প্রাসঙ্গিক। অপ্রাসঙ্গিক কথা রুপার মুখ দিয়ে বের হতে দেখিনি। আর বাসর রাতে এতো কথা বলেছে যে আমার ওকে অচেনা লাগছিল। আমি অবাক হবো নাকি মুগ্ধ, তা বুঝতে পারছিলাম না। কোনো সাজগোজ ছাড়া এই মেয়ে সাক্ষাৎ পরী। বিয়ের সাজ যতোই মুছে দিচ্ছিল, ততোই আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ওইদিকে কথার পরিমান বেড়ে চলছিল। কোনো রোমান্টিক কথা না। কবে কি করেছে না করেছে, কি বলেছে না বলছে সেইসব গল্প।
রুপার প্রেমে হাবুডুবু অবস্থা ছিল আমার। এখনো আমি সেই সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। ওর চোখের মায়ায় আজও আমি ডুবে থাকি। মা বাবার সাথে ওর সেকি খাতির। মা কে নিয়ে প্রায়ই পার্লারে যেতো। আমাকে ফেলে তিনজনে রেস্টুরেন্টে খেতে যেতো। আমার জন্য আবার একটুখানি পার্সেল ও নিয়ে আসতো। কোনো বিয়ের ফাংশনে দেখতাম মা আর রুপা একই রকম শাড়ি পড়ে যেত। আমার বড় ভাবী উত্তরার ফ্ল্যাট থেকে আসতো আমাদের বাসায়, আর এসব দেখে মুখ ভেংচি কেটে চলে যেতো হিংসায়। রুপা অফিস থেকে বিদেশে কোনো ট্যুরে গেলে মাকে নিয়ে যেতো। বাবা চাকুরীর সুবাদে অনেক দেশ ঘুরলেও মা কখনো কোথাও যায়নি। তাই রুপা মা কে নিয়ে ঘুরতে যেতো। আমি আর বাবা তখন নিজেরা রান্না করে খেতাম। পিকনিকের মতো। আমরা চারজন বেজায় খুশি ছিলাম।
কিন্তু সেই খুশি বেশিদিন ছিল না। বিয়ের দুইবছর পরও যখন রুপা কন্সিভ করল না তখনি অশান্তি দানা বাঁধা শুরু করল সংসারে। রুপা আর আমি যখন অফিসে থাকতাম, প্রায়ই বড় ভাবী বাসায় এসে তখন মাকে অনেক কিছু বলে যেতো। ধীরে ধীরে মা রুপাকে ভুল বুঝতে শুরু করল। আমি আমার মতোই। রুপাই আমার ধ্যান জ্ঞান সব। বাচ্চা আমার চাই, তবে রুপাকে হারিয়ে নয়। কিন্তু রুপা ও দিনকে দিন মনমরা হয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে কাঁদত। ওর একটা বাচ্চার অনেক শখ। ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি শুরু হল আমাদের বাবার পরামর্শে।
কিন্তু যেদিন আমি জানতে পারলাম রুপা সম্পূর্ণ সুস্থ এবং সমস্যা আমার, সেদিন আমার দুনিয়া থমকে গিয়েছিল। আমার সিমেনে স্পার্মের সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কম। এটা কনফার্ম হওয়ার জন্য ডাক্তার একটা টেস্ট দিল। যেটার রিপোর্ট দিলো এক সপ্তাহ পর। এই এক সপ্তাহ আমি যে কি মানসিক অ*শান্তির মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম তা শুধু আমি জানি। রুপা আগের মতোই। বরঞ্চ আগের তুলনায় আরো বেশি বাঁচাল হয়ে গিয়েছিল। আমি বুঝতাম সমস্তটাই ওর অভিনয়। রুপা আমাকে শক্ত রাখার জন্য এতো কথা বলতো। যেন আমি ওসব ভুলে থাকি। এক সপ্তাহ পর ডাক্তার কনফার্ম করলেন সমস্যা আমার। সেদিন রুপার জন্মদিন ছিল। ডাক্তার ঔষধ দিলেন। আর বললেন আল্লাহকে ডাকতে। মিরাকেল হলেও হতে পারে। রুপা আমাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বার থেকে রেস্টুরেন্টে গেলো। ওর বার্থডে ট্রিট দেবার জন্য। আর নিজের জন্মদিনের উপহার হিসেবে চাইল, আমি যেন বাসায় গিয়ে বলি সমস্যা টা রুপার। রাজি হলাম না। হাজার জোরাজোরি করেও রুপা আমাকে রাজি করাতে পারেনি। বাসায় ফিরে অকপটে সব সত্যি বলে দিলাম।মা বাবা চরম বিমর্ষ মুখ নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেল।
মা নরম মনের মানুষ। মা কথাটা আপন মনে করে বড় ভাবীকে বলে দিল। বড় ভাবী প্রযুক্তির দৌলতে পরিচিত অপরিচিত সবাইকে এই কথাটা জানাল। বড় ভাবী চেয়েছিল নিজের বোনকে আমার সাথে বিয়ে দিতে, আমি রাজি না হওয়ায় মনের মধ্যে আমার জন্য বিশাল ক্ষোভ পুষে রেখেছিলেন। যার ফলস্বরূপ এই কাজটা করলেন। রুপার ভাইদের কানেও কথাটা বড় ভাবীই তুলেছিলেন। বড় ভাবী পরদিন বাসায় এসে আমাকে বলল রুপাকে ছেড়ে দিতে। রুপার মতো মেয়ের জীবন যেন আমি নষ্ট না করি। আমি ছেড়ে দিলে রুপা অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হতে পারবে৷ আমি কানে নিলাম না। কারন রুপা স্বাভাবিক। আগের মতো। কিন্তু যখন রুপার বাসার সবাই আমাদের বাসায় এসে রূপাকে নিয়ে যেতে চাইলে রুপা গেল না, এবং আমাকে রুপার বাবা রুপার অগোচরে হাত ধরে অনুরোধ করলো রুপার জীবনটা নষ্ট না করতে তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম রুপাকে ডিভোর্স দেওয়ার। রুপাকে ডিভোর্সের কথা বলতেই রুপা চন্ডীরূপ ধারন করল। ঝগড়ার একপর্যায়ে আমাকে জোরেশোরে থা*প্প*ড় ও মারল। আমার অসম্ভব ভাল লাগছিল। আমার মনে হচ্চ্ছিল রুপা আমাকে লাথি মারলেও আমার ভাল লাগতো।
এর পরের এক সপ্তাহ আগের মতো। দারুন সুন্দর ছিল। আমাদের মনেই ছিল না আমাদের কখনো বেবি হবে না। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই আমি অন্যরকম হয়ে গেলাম। আমি মানুষের কথায় প্রভাবিত হয়ে রুপাকে ভালবাসার প্রমান দিতে রুপাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুনরায় গ্রহন করলাম। বিপরীতে রুপা ও আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল তখন রুপা আমাকে দয়া করছে। শুরু হল চরম অশান্তি। রুপার আর আমার ঝগড়া। ঝগড়া টা ছিলে একতরফা। আমিই করে যেতাম। পাগল হয়ে গিয়েছিলাম তখন। অকারনেই রুপার গায়ে হাত তুলতাম। অমানুষিক নির্যাতন চালাতাম। সারারাত মার খেয়েও সকাল বেলা রুপা আমার সাথে হেসে কথা বলতো। যেন কিছুই হয়নি। আমার নিজেকে অমানুষ মনে হতো। বিবেকে মরিচা ধরে গিয়েছিল তখন। মা বাবা আটকানোর চেষ্টা করতো। পারতো না।
টানা একমাস এমনিভাবে চলার পর বাবা একদিন রুপাকে ওর বাসায় দিয়ে আসল। আমি সেদিন অফিস থেকে ফিরে খালি রুমে রুপার বালিশ জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম রুপার জন্য কি পরিমান ভালবাসা আমি বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম।
মা আমার পাশে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, "সুখের সংজ্ঞা সবার কাছে এক না।"
আমার বিক্ষিপ্ত মনের একাংশ বলতো, রুপা আমাকে ছাড়া ভাল নেই, পরক্ষনেই আরেক অংশ বলে উঠত, সাময়িক কষ্ট কিছুই না দীর্ঘস্থায়ী সুখের কাছে। রুপা পরে ভাল থাকবেই।
এমন দোটানায় দিন কাটতে লাগল আমার। এর ঠিক একমাস পর রুপার বাবা একদিন বিকালে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করল, রুপা আমার বাসায় ঠিকঠাক মতো পৌছেছে কি না। আমি অবাক। রুপা আমার বাসায় আসেনি। কল দিলাম রুপার নাম্বারে। এই একমাস আমি রুপাকে একবারের জন্য ও কল মেসেজ দিই নি। রুপাও দেয়নি আমাকে কল। রুপার নাম্বার বন্ধ। দৌড়ে গেলাম রুপার অফিসে। গিয়ে জানলাম রুপার প্রমোশন হয়েছে। রুপাকে চট্টগ্রামে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। রুপা সেখানে চলে গেছে। বাসায় কাউকে কিছু জানায়নি। তাই রুপার বাসার সবাই রুপার লাগেজ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়াকে ধরে নিয়েছে আমার বাসায় প্রত্যাবর্তন। আমি একবুক কষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম।
পরদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। রুপা উঠেছে অফিসের দেওয়া বাসায়। রুপার অফিস থেকে ঠিকানা নিয়ে চলে গেলাম রুপার কাছে। জড়িয়ে ধরে বসেছিলাম অনেকক্ষন। রুপা চুপচাপ। নির্লিপ্ত। কষ্টে চোখে পানি চলে এসেছিল। কিন্তু রুপা নির্বিকার।
বাজার করে নিজের হাতে রেঁধে নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়ার পর ও মহারানীর রাগ ভাঙল না। রাগ ভাঙল রাত দুইটায়৷ ফয়েসলেকের ঘন জঙ্গলের পাশে রুপার বিল্ডিং৷ ১৪ তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে পুরো ফয়েসলেকটা দেখা যায়। ভরা পূর্নিমা। রুপাকে জোর করে ধরে ছাদে নিয়ে দিয়েছিলাম। দূর থেকে যে কেউ দেখলে বলতো আমি রুপাকে কিডন্যাপ করছি। ছাদের বেঞ্চে বসিয়ে রুপার কোলে মাথে রেখে আমার অশ্রু বিসর্জন শুরু হল। খুব করে ক্ষমা চেয়ে মুখ তুলতেই দেখি রুপা এক দিঘী সমান জল চোখে জমিয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। দুজনেই কাঁদলাম খুব।
সেই থেকে শুরু হল আমার ঢাকা চট্টগ্রাম দৌড়াদৌড়ি। প্রত্যেক সপ্তাহে রুপাকে দেখতে যাই। ঈদে রুপাকে সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে আসতাম৷ নিজেকে বাইশ বছরের যুবক মনে হতো, আর রুপাকে অষ্টাদশী। লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ আমাদের। রাত জেগে কথা বলতে বলতে রুপা ভিডিও কল অন রেখেই ঘুমিয়ে যেতো। আমি ওকে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তাম।
একবছর পর রুপা ট্রান্সফার হয়ে ঢাকা আসল। শুরু হল আমাদের আগের মতো জীবন। সুখের বন্যা। সেই বন্যায় নতুন ঢেউ হিসেবে যোগ হলো আমাদের সন্তান আসার খবর। ট্রান্সফার হয়ে আসার চারমাস পর রুপা জানাল সে প্রেগন্যান্ট। চারজন ডাক্তার দিয়ে রুপা কনফার্ম হয়েছিল। তাও রুপা অবিশ্বাসের চোখে রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে ছিল।
তারপর শুরু হল রুপার উপর মায়ের মধুর অত্যাচার। রুপার "খাই না" কথাটা উঠে গেল বাসা থেকে। করলা থেকে শুরু করে চালকুমড়া , লাল শাক থেকে শুরু করে নাম না জানা উদ্ভট শাক, ছোট মাছ থেকে শুরু করে কোরাল মাছ, খাসির মাংস থেকে শুরু করে হরিনের মাংস সবই রুপাকে এই নয়মাস খেতে হয়েছিল। রুপার মা ভাবীরা আরো একধাপ এগিয়ে। রুপা আচার জিনিসটা খুব বেশি রকমের অপছন্দ করে। কিন্তু রুপার মা ভাবীরা রুপাকে চালতার আচার থেকে শুরু করে রসুনের আচার পর্যন্ত সব রকমের আচার বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এবং তিনবেলা ফোন করে খবর নিতো ওইসব আচার রুপা খেয়েছে কি না। রুপা ছিল চার ভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন। সবচেয়ে আদরের, সবচেয়ে স্নেহের ছিল রুপা। তাই রুপার প্রতি অধিকারবোধ টাও ছিল সবার চরম।
লেবার রুমে নেওয়ার আগেও রুপা আইসক্রিমের বক্স হাতে আমাকে হাত নেড়ে টাটা দিচ্ছিল। আমি অশ্রু সজল চোখে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। দুইঘন্টা পর নার্স একটা তোয়ালেতে প্যাচানো একটা বাচ্চা আমার হাতে দিয়ে বলেছিল "কংগ্রেচুলেশন, আপনার ছেলে হয়েছে"
রুপার বাবা আমার ছেলের কানে আযান দেওয়ার কিছুক্ষন পরেই রুপাকে কেবিনে দেওয়া হয়।
রুপার সেন্স ফিরলে রুপার ছেলেকে রুপার হাতে দেওয়া হয়। ডাক্তার থেকে শুরু করে সব আত্মীয় স্বজন সবাই আমার ছেলেকে দেখে বলেছিল ছেলে অবিকল আমার মতো হয়েছে। এটা শুনে রুপার সেকি কান্না। কেন তার ছেলে তার মতো দেখতে হল না। আমার মা আর রুপার মা মিলে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে রুপাকে থামিয়েছিল।
সেইদিন সবাই বাসায় ফিরলেও আমি থেকে গিয়েছিলাম হসপিটালে।
ভরা পূর্নিমা। রুপার কেবিনে বিশাল জানালা থেকে চাঁদটাকে পুরো দেখা যাচ্ছিল। চাঁদের আলোয় আমার ছেলেকে কি অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছিল। রুপা আইসক্রিমের বক্স সামনে নিয়ে হাত নেড়ে বলছিল ওটিতে কি হয়েছিল না হয়েছিল। ও কি ভেবেছিল না ভেবেছিল। আর আমি ভাবছিলাম যদি সেদিন রুপার চট্টগ্রাম চলে যাওয়ার খবর শুনে পাগলের মতো ছুটে না যেতাম, যদি নিজের ভুল নিজে বুঝতে না পারতাম তাহলে আজকের এই সুন্দর মুহুর্তটা আমি কখনো কি পেতাম?
নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম