ভুল রিপোর্ট। লেখিকা:জেনিফা চৌধুরী।

 আপুউউউ......কারোর গলা ফাটানো চিৎকার শুনে বাড়ির লোক দৌড়ে এসে দেখে জেনিফার নিথর দেহটা ফ্যানের সাথে ঝুলছে।বাড়ির সব মানুষের মাথায় যেনো রীতিমতো আকাশ ভেঙে পড়লো।জেনিফার মা গিয়ে জেনিফার পা দুটো জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।জেনিফার বাবা মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে নিচে বসে পড়লো।মুহূর্তেই ঘর জুড়ে শুরু হয়ে গেলো মরা কান্না।কিছুক্ষনেই মধ্যেই জেনিফার লাশ টা নিচে নামানো হলো।মুহূর্তেই গ্রামের লোক জনের ভিড় পড়ে গেলো ওদের বাড়িতে।জেনিফার মায়ের মেয়ে হারানোর আতৎনাদে সবার বুক কেঁপে উঠছে।ভিড়ের মধ্যে মানুষ কানাকানি শুরু করেছে।কেউ আফসোস করছে কেউ বলছে,,,,,,

---- এইরকম নোংরা মেয়ের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই?মা-বাবার নাক কান কেটে এখন এসেছে গলায় দড়ি দিতে মরে গেছে ভালো হয়েছে?এর দেখা দেখাই আরো ১০ টা মেয়ে খারাপ হতো?
ভিড়ের মধ্যে থেকে কারোর এমন কথা শুনে জেনিফার বোন জুবাইয়া রাগে চিৎকার করে বলতে শুরু করলো,,,,
---- আমার বোন নোংরা না।আমার বোনের নামে আপনারা মিথ্যা অপবাদ দিয়েছেন বলেই আজ আমার বোন টা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।আমার বোন কতটা নিস্পাপ সেটা শুধু আমি জানি।আজ যদি আপনাদের মেয়ের সাথে এমন হতো সহ্য করতে পারতেন তো।আপনারা ভুলে যাচ্ছেন আপনাদের ঘরে ও মেয়ে আছে।অন্য একটা মেয়ের উপর এত বড় একটা মিথ্যে অপবাদ দিতে আপনাদের গলা কেঁপে উঠেনি।নাহ তা উঠবে কেনো আপনারা তো সত্যি বলেছেন তাইনা।আর এখন আমার বোন টা যখন মরে গেছে তারপর ও আপনারা এমন নোংরা কথা বলছেন।কেনো?একটা মানুষের মৃত্যু কামনা করা কত বড় অন্যায় সেটা একবার ও ভাবলেন না।আমার বোন কে নোংরা বলার আগে একবার৷ নিজের মেয়ের খোঁজ নিয়ে দেখুন সে কোন দুধের ধোয়া তুলসি পাতা।
জুবাইয়ার রাগে চিৎকার করে বলা কথাগুলো শুনে উপস্থিত সবাই নিশ্চুপ হয়ে আছে।ওর কথা শুনে কয়েকজন মানুষ আস্তে করে সাইড কেটে চলে গেলো।জুবাইয়া আর জুবাইয়ার মায়ের বিলাপ শুনে কয়েকজনের চোখে পানি টলমল করছে
***********
"অতিত"
জেনিফা এইবার ইন্টার ফাস্ট ইয়ারের ছাত্রী।গ্রামের মেয়ে হওয়ায় ওর চাল চলন অনেক সুন্দর ভাবে ছিলো।সব সময় পর্দা করে চলতো।কোনো ছেলের সাথে অব্দি কথা বলতোনা।অনেক চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। জেনিফারা দুই বোন।বাবা কলেজের বাংলা শিক্ষক।মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে।জেনিফা রুপে গুনে সব দিক দিয়ে পারফেক্ট হওয়ায় গ্রামের কয়েক টা বখাটে ছেলে ওকে অনেক ডিস্টার্ব করে।জেনিফা মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করলেও সব সময় প্রতিবাদ করার সাহস পেতোনা।মাঝে মাঝেই জেনিফাকে রাস্তায় দেখলে ওরা বিরক্ত করতো।কখনো হাত ধরে টান দিতো কখনো বা ওকে দেখে বাজে কথা শুরু করতো।গ্রামের সবাই ভাবতো হয়তো ওই ছেলে গুলোর সাথে জেনিফার কোনো সম্পর্ক আছে।তাই জেনিফা কে সবাই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতো।
কিছু দিন যাবৎ জেনিফার খাওয়ার রুচি চলে গিয়েছিলো।ক্ষুদার্ত মনে হতো নিজেকে অনেক।খাওয়ার পর মনে হতো এখনো পেট খালি,আবার মাঝে মাঝে খালি পেটে থাকলে মনে হতো পেট ভরা।খাওয়ার সামনে গেলেই মাঝে মাঝে বমি করে দিতো।মাথা ঘুরে কয়েকবার পড়ে গিয়েছিলো এইসব বিষয় গুলো নিয়ে জেনিফার পরিবারের সবাই চিন্তিত ছিলো।সবাই অন্য কিছু ভেবেছিলো।এই জন্য ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাহলে ডাক্তার কিছু টেস্ট করতে দিয়েছিলো।মুহূর্তেই গ্রাম ছড়িয়ে পড়লো জেনিফা বিয়ের আগেই মা হতে যাচ্ছে।সবাই মিথ্যে অপবাদ দিতে লাগলো জেনিফা নোংরামির ফল এইগুলো।সারাগ্রাম ওদের নিয়ে কানা ঘুষা শুরু হয়ে গেলো।রাস্তায় বের হলেই জেনিফার পরিবার কে বিভিন্ন ভাবে হ্যারেসমেন্ট করা হতো।এইসব কিছু নিয়ে জেনিফা অনেক টাই ভেঙে পড়েছিলো।কাল রিপোর্ট এসেছে এতে স্পষ্ট লেখা জেনিফা ৩ মাসের পেগন্যান্ট।রিপোর্ট টা দেখা মাত্রই সবার মাথায় বাশ ভেঙে পড়লো।জেনিফার বাবা ও কাল জেনিফার গায়ে হাত তুলেছে।লজ্জা আর মান সম্মানের ভয়ে জেনিফা নিজের জীবন টা শেষ করে দেয়।
***********
আসর শেষে দাফন করা হলো জেনিফা কে।জুবাইয়া বোন কে হারিয়ে অনেক ভেঙে পড়েছে।জেনিফার রুমে এসে জেনিফার জামা কাপড় গুলো বুকে আগলে কান্না করে যাচ্ছে।জুবাইয়া কিছুতেই বিশ্বাস করেনা জেনিফা কোনো নোংরা কাজ করতে পারে কিন্তু রিপোর্ট তো বলছে জেনিফা ভুল।
পরের দিন সকালে,,
সবাই মন মরা হয়ে ড্রয়িং রুমে বসেছিলো।শুধু মাত্র জেনিফার মা বাদে।মেয়েকে হারিয়ে পাগল পাগল হয়ে গেছেন উনি তাই ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।সবার উপস্থিতির মাঝে হুট করে কলিং বেল বেজে উঠলে সবার হুশ ফিরে আসে।জুবাইয়া উঠে গিয়ে দরজা খুলে একটা ২৫-২৬ বয়সী ছেলেকে দেখতে পেয়ে অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলো,,,,
__কে আপনি?
ছেলেটি গলা ঝেড়ে বলে উঠলো,,,
_কিছু মনে না করলে ভেতরে যেতে পারি?
জুবাইয়া ও কথা না বাড়িয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দেওয়ার সাথে সাথে ছেলেটা জুবাইয়াকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে যেতেই উপস্থিত সবাই প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকায় ছেলেটা আমতা আমতা করে মাথা নিচু করে শান্ত কন্ঠে বললো,,,,
--আমি জানিনা কথা টি কিভাবে বলবো আপনাদের।আসলে গত দুইদিন আগে জেনিফা চৌধুরীর নামে যে প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট টা এসেছিলো সেটা আসলে ভুল রিপোর্ট ছিলো।সেই রিপোর্ট টা অন্য একজনের ছিলো দুজনের নামের মিল থাকায় আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছিলো।
এর জন্য আমরা খুবই দুঃখ প্রকাশ করছি।আর ক্ষমা প্রার্থনা করছি।আসলে আপনাদের বাড়ির মেয়ের পেটে টিউমার ছিলো।অতি শিঘ্রই তার অপারেশন করা জরুরি। এই তার রিপোর্ট,,
বলেই ছেলেটা হাতে থাকা রিপোর্ট টা জেনিফার বাবার দিকে বাড়িয়ে দিলো।ছেলেটার কথা শুনে উপস্থিত সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।জেনিফার বাবা কয়েকপা পিছিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো।জুবাইয়া নিজেকে কন্টোল করতে না পেরে ছেলেটার হাত থেকে রিপোর্ট টা নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললো।তারপর চেচিয়ে বলে উঠলো,,,
---কার অপারেশন করাবেন আপনারা যে কিনা কালকে সুইসাইড করে মারা গেছে সেই মেয়েটার। শুধু মাত্র আপনাদের একটু ভুলের কারনে আজ আমার নির্দোষ বোন টা সুইসাইড করেছে।আপনাদের ভুলের জন্য গ্রামের প্রত্যেক টা মানুষের কাছে আমার বোনের সম্মান ধুলোয় মিশে গেছে।আর আপনারা দুইদিন পর এসেছেন রিপোর্ট অদলবদল করতে।বাহঃ এইটা বুঝি আপনাদের দায়িত্ব।আপনাদের একটু মাত্র #ভুল_রিপোর্ট আমার বোনের জীবন টা শেষ করে দিলো।
বলেই জুবাইয়া কান্নায় ভেঙে পড়লো।ছেলেটা অবাক চাহনী নিক্ষেপ করে আছে জুবাইয়ার দিকে।অপরাধবোধে মরে যাচ্ছে।শুধু মাত্র একটা ভুল_রিপোর্টের জন্য আজ একটা মেয়ের জীবন চলে গেলো।এটা ছেলেটা কিছুতেই মানতে পারছেনা।একটা মাত্র ভুল_রিপোর্ট ও কারোর প্রান কেড়ে নেয়?????
নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম