বদদোয়ার_কুফল।#sharmin_akter_borsha

 খাবার খেতে বসে মাছের বড় মাথাটা পাতে নিয়ে খেতে যাবো ঠিক সেই মূহুর্তে কে জেনো পাশ থেকে আমার খাবার বাটিটা হাত থেকে টান মারল। আমি নিস্তব্ধ হয়ে পরলাম। কি হলো বুঝার আগেই ঠাসস করে একটা শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি আমার খাবার প্লেটটা ফ্লোরে পরে আছে। ভাত ও মাছের ঝোলে মেঝে নোংরা হয়ে গেছে। প্লেটটার দিকে তাকিয়ে হতাশাজনক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পাশে তাকালাম। দেখি রাগান্বিত চোখে মা আমারই দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছে।

আমি নির্মূল কন্ঠে বললাম,‘মা আমায় খেতে দিলে না কেন?’
তিনি কোনো কিছু না বলে আমার গালে সজোরে এক চড় বসালেন। চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরল। কান্না ভেজা কণ্ঠে বললাম,‘আমায় মারছো কেন মা!’
এটা নতুন নয়, দিনে উঠতে বসতে হাজার বার ঝাঁটার বাড়ি খেতে হয়। তাও তো ভালো এইবার চড় মারল।
তিনি আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির উঠান অব্ধি নিয়ে আসল। আমার ছোট্ট ছোট্ট হাতটি ধরে ধাক্কা দিয়ে উঠানের মধ্যখানে ফেলে দেয়। সিঁড়ির পাশ থেকে একটা লাঠি নিয়ে এসে আমার গায়ে আঘাত করতে লাগল। আমি আঘাত গুলো সহ্য করতে পারছিলাম না। আর করবোই বা কিভাবে দশ বছর বয়সের ছোট্ট ছেলের এত মার সহ্য করার ক্ষমতা কি আছে? নেই, আল্লাহ দেননি। সন্তান তো আল্লাহর নিয়ামত তাদেরকে শুধু ভালোবাসতে হয়। কিন্তু আমার কপালে কারো ভালোবাসা লিখা নেই।
তিন বছরের ভাই'টা উঠানের একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। হয়তো আমাকে মার খেতে দেখে ওর কষ্ট হচ্ছে। ও যাতে আর কান্না না করে সেজন্য আমি এত কষ্টের পরও ওর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করছি। এদিকে মা আমার পিঠে আরও জোরে আঘাত করছে। মারতে মারতে এক পর্যায়ে কর্কশকন্ঠে বলল,
‘তুই মরতে পারোস না জানো'য়ারের বাচ্চা? নিজের মা'রে তো খাইছোস এহন কি আমাগো খাইতে বাঁইচা আছোস? সারাদিন খালি খাই আর খাই। খাইতে খাইতে তো এই বয়সে হাতির বাচ্চার মতোন হইয়া গেছোস। খাওয়ার আগে ভাবিস না ঘরের আর মানুষ কি খাইবো। তোর মা'য় তো মইরা গিয়া বাঁইচা গেছে। জ্বালা হইছে গিয়া আমার। মাইনষে ঠিকই কয় সতিন ভালা তাও সতিনের কাটাকুটা ভালা না। আমি যদি তোরে আমার ত্রিসীমায় আর দেহি বুঝিস সিয়াম তখনই তোর গলা দোর থেকা কাইটা লামু।’
বলে ছোট্ট ভাই টাকে কোলে তুলে নিয়ে মা চলে গেলেন। রুমের মধ্যে ঢুকে দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করে দেন। আমি উঠান থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করলাম। দুই চোখ দিয়ে ঝর্ণার মতো পানি পরছে। বুঝতে পারছি না কোথায় যাবো? যাওয়ার যে আমার কোনো জায়গা নেই। বাবা আমার মাঠে কাজ করছে। সেখানে গেলেও লাভ নেই। বাবাকে বললে তিনি মা'কে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন। মা সত্য কথা লুকিয়ে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলবে। মা'র কথা বিশ্বাস করে বাবা নিজেও আমাকে মারবে মুখে যা আসবে তাই বলবে। প্রতিবারই এমন হয়। তার চেয়ে ভালো মনে মনে ভাবলাম দূরে কোথাও চলে যাবো। যেথায় গেলে কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না। শুধু মনের মধ্যে একটাই ভয় ছোট্ট ভাই টাকে আর দেখতে পাবো না। চাইলেও ছুঁতে পারবো না। কান্না করলে কোলে নিতে পারবো না।
ছলছল নয়নে, হাঁটতে হাঁটতে কখন যে নদীর ঘাটে চলে আসছি খেয়াল করিনি। নদীর স্বচ্ছ পানির দিকে তাকালাম দেখতে পাচ্ছি অনেক গুলো নৌকা জলে ভাসছে। অন্য দিকে তাকাতে চোখে পরল, নদীর জলে ভাসা শাপলাপাতার উপরে গোলাপি রাঙা শাপলা ফুল ফুটে আছে। খুবই সুন্দর লাগছে ফুলগুলো। বাতাসে পানির সাথে ফুলগুলো পানির উপরে ঢেউ খাচ্ছে। দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলাম। হঠাৎ কে জেনো পেছন থেকে আমাকে ধাক্কা মারল। আমি কিছুটা সামনে পরে গেলাম। আমার পা থেকে একটা জুতা খুলে নিচে পরে গেলো একটু ঝুলে আছে বৈকি পুরোপুরি পানিতে পরেনি। আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একটা লোক একহাত কানে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হয়তো ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। তাই আমায় দেখতে পায়নি।
জুতা ছাড়া বাড়ি গেলে বাবা মা দু'জনই অনেক মারবে। ভেবে আমি সাহস করে এগিয়ে গেলাম জুতাটা আনতে প্রথমে একটু ভয় লাগলো যদি পরে যাই? কিন্তু পরে যাওয়ার থেকে মনের মধ্যে মার খাওয়ার ভয়টা বেশি কাজ করছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আমার হাত জুতা অব্ধি পৌঁছাচ্ছে না। তাই আর একটু নিচে নামলাম এবারও সফল হলাম না দেখে আরও একটু নিচে নামলাম এবার জুতাটা সহজেই হাতে পেলাম। এমন সময় পেছন থেকে এক মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসল। সে বলল,‘সিয়াম তুই ওখানে কি করছিস?’
পেছনে তাকিয়ে দেখলাম সোফিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমি অনেক খুশি হলাম। আনন্দে উল্লাসিত কণ্ঠে বললাম,‘সোফিয়া তুই আসছিস।’
বলে তারাহুরো করে উঠতে যাবো সেই সময় পা পিছলে পেছন দিকে পরে গেলাম। ঠাসস করে একটা শব্দ হল তলিয়ে গেলাম আমি নদীর গভীর জলে। উপর থেকে সোফিয়া, ‘সিয়াম’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠল।
কিয়ৎক্ষণের মধ্যে গ্রামের কিছু সংখ্যক মানুষ জড়ো হল আমাকে পানি থেকে উদ্ধার করল। সকলে আমাকে দেখেই চিনে ফেলো। তাই আমাকে কোলে করে আমার বাড়িতে নিয়ে আসে। এই সেই উঠান যেখানে আমি কয়েক ঘন্টা আগে মার খেয়েছিলাম এখন ওই উঠানেই কাঠপোড়া রোদে শুয়ে আছি। বাবা আমাকে দেখেই এক দৌঁড়ে ছুটে আসল, দুই হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে গালে চুমু দিতে শুরু করল। বুকের মধ্যে নিয়ে তার আষ্টেপৃষ্টের সাথে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। দেখলাম দূরে দাঁড়িয়ে আমার মা'ও কাপড়ের আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছে। তবে আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে, তিনি কি সত্যিই কাঁদছেন নাকি সকলের সামনে নাটক করছে?
এখন এই মূহুর্তে আমার বাবাকে দেখে বলতে ইচ্ছে করছে,‘ এই ভালো বাসাটা যদি আমি বেঁচে থাকতে দেখাতে বাবা। তাহলে হয়তো আমার জীবনটা অন্য রকম হত। বেঁচে থাকতে বাবার ভালোবাসা পেলাম না আর এখন যখন পাচ্ছি তখন অনুভব করতে পারছি না। আর না তোমাকে স্পর্শ করতে পারছি। এতগুলো মানুষের ভিড়ে আমার নিস্তেজ দেহটা জড়িয়ে তুমি কাঁদছো বাবা। তা দেখে আমার দুই চোখ দিয়ে অশ্রুকণা গাল বেয়ে গড়িয়ে পরছে। আমার যে বুক চিঁড়ে রক্ত জোড়ার মতো কষ্ট হচ্ছে। কতই না বাবা বাবা বলে ডাকছি। কিন্তু দূর্ভাগ্য দেখো বাবা, তুমি না আমাকে দেখতে পাচ্ছো আর না আমাকে শুনতে পারছো। তোমার বুক থেকে তোমার আদরের সন্তান চিড়ে তরে হারিয়ে গেল বাবা। সময়ের সাথে সাথে সবার মতো তুমিও কি আমাকে ভুলে যাবে বাবা নাকি মনের মধ্যে কোথাও লুকায়িত বেদনা হয়ে রয়ে যাবো? বাবা তুমি এখন খুশি হয়েছো তো? দেখো, তোমাদের বদদোয়া গুলো আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন।’
🌼_____সমাপ্ত____🌼
নবীনতর পূর্বতন

যোগাযোগ ফর্ম